আর স্মরণ করুন যখন আমরা ইবরাহীমের জন্য নির্ধারণ করে দিয়েছিলাম [১] ঘরের স্থান [২], তখন বলেছিলাম, ‘আমার সাথে কোন কিছু শরীক করবেন না [৩] এবং আমার ঘরকে তাওয়াফকারী, সালাতে দণ্ডায়মান, এবং রুকু ও সিজদাকারীদের জন্য পবিত্র রাখুন [৪]
____________________
চতুর্থ রুকু’
[১] এ আয়াতে যারা আল্লাহ ব্যতীত অন্য কারও ইবাদাত করে তাদের ব্যাপারে সাবধান করা হয়েছে। যারা আল্লাহর সাথে এমন ঘরে শির্ক করে যার ভিত্তি রচিত হয়েছিল তাওহীদের উপর। আল্লাহ জানিয়ে দিচ্ছেন যে, তিনি ইবরাহীম আলাইহিস সালামকে সেটার স্থান দেখিয়ে দিলেন, তার কাছে সমৰ্পন করলেন এবং তা তৈরী করার অনুমতি দিলেন। [ইবন কাসীর] অভিধানে بوأ শব্দের অর্থ বর্ণনা করা। [জালালাইন] অপর অর্থ, তৈরী করা, কারণ সেটার স্থান অপরিচিত ছিল। [মুয়াসসার] আয়াতের অর্থ এইঃ একথা উল্লেখযোগ্য ও স্মর্তব্য যে, আমি ইবরাহীম 'আলাইহিস সালাম-কে বায়তুল্লাহর অবস্থানস্থলের ঠিকানা বর্ণনা করে দিয়েছি। আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেনঃ যখন ইবরাহীম আলাইহিস সালাম-কে ঘর বানানোর নির্দেশ দেয়া হলো, তিনি বিবি হাজেরা ও ইসমাঈলকে নিয়ে তা বানাতে বের হলেন, যখন মক্কার উপত্যকায় আসলেন তখন তিনি তার মাথার উপর ঘরের স্থানটুকুতে মেঘের মত দেখলেন, যাতে মাথার মত ছিল, সে মাথা থেকে ইবরাহীম ‘আলাইহিস সালাম-কে বলা হলঃ হে ইবরাহীম! আপনি আমার ছায়ায় বা আমার পরিমাণ স্থানে ঘর বানান, এর চেয়ে কমাবেন না, বাড়াবেনও না। তারপর যখন ঘর বানানো শেষ করলেন, তখন তিনি বের হয়ে চলে গেলেন এবং ইসমাঈল ও হাজেরাকে ছেড়ে গেলেন, আর এটাই আল্লাহর বাণীঃ وَاِذْبَوَّاُنَالِاِبْرٰهِيْمَ আয়াতের মর্মার্থ। [মুস্তাদরাকে হাকিমঃ ২/৫৫১]
[২] مَكَانَ الْبَيْتِ শব্দে ইঙ্গিত রয়েছে যে, বায়তুল্লাহ্ ইবরাহীম আলাইহিস সালাম-এর আগে থেকেই বিদ্যমান ছিল। বিভিন্ন বর্ণনায় এসেছে যে, এর প্রথম নির্মাণ আদম 'আলাইহিস সালাম-কে পৃথিবীতে আনার পূর্বে অথবা সাথে সাথে হয়েছিল। আদম 'আলাইহিস সালাম ও তৎপরবতী নবীগণ বায়তুল্লাহ তাওয়াফ করতেন। কিন্তু এ সমস্ত বর্ণনা খুব শক্তিশালী নয়। সহীহ বৰ্ণনানুসারে ইবরাহীম আলাইহিসসালামই প্রথম কা'বা শরীফ নির্মাণ করেছিলেন। তখন আয়াতের অর্থ হবে, আমরা তাকে হবু ঘরের স্থান দেখিয়েছিলাম। এ অর্থ হবে না যে, সেখানে ঘর ছিল আর তা নষ্ট হয়ে যাবার পরে আবার তা ইবরাহীম আলাইহিসসালামকে নির্মাণের জন্য দেখিয়ে দেয়া হয়েছিল। ইবনে কাসীর রাহেমাহুল্লাহ বলেন, এ আয়াত থেকেই অনেকে প্রমাণ করেছেন যে, ইবরাহীম আলাইহিস সালামই প্রথম আল্লাহর ঘর নির্মাণ করেছেন। তার পূর্বে সেটি নির্মিত হয়নি। এর সপক্ষে প্রমাণ হচ্ছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এক হাদীস, আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! কোন মসজিদটি প্রথম নির্মিত হয়েছে? তিনি বললেন, মাসজিদুল হারাম। আমি বললাম, তারপর কোনটি? তিনি বললেন, বাইতুল মুকাদ্দাস। আমি বললাম, এ দুয়ের মাঝখানে কত সময়? তিনি বললেন, চল্লিশ বছর। [বুখারী: ৩৩৬৬; মুসলিমঃ ৫২০]
[৩] অর্থাৎ ইবরাহীম আলাইহিস সালাম-কে এই ঘরের কাছেই পুনর্বাসিত করার পর কতগুলো আদেশ দেয়া হয়। তন্মধ্যে প্রথম নির্দেশটি ছিল সর্বকালের সবচেয়ে বড় গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশ। আর তা হলো, ‘আমার সাথে কাউকে শরীক করবেন না।” ইবন কাসীর বলেন, এর অর্থ, একমাত্র আমার জন্যই এ ঘরটি বানাবেন। অথবা এ ঘরে শুধু আমাকেই ডাকবেন। অথবা এর অর্থ, আমার সাথে কাউকে শরীক করবেন না। [ফাতহুল কাদীর]
[৪] দ্বিতীয় আদেশ এরূপ দেয়া হয় যে, আমার গৃহকে পবিত্র রাখুন। পবিত্র করার অর্থ কুফর ও শির্ক থেকে পবিত্র রাখা। [ইবন কাসীর; ফাতহুল কাদীর] অনুরূপভাবে বাহ্যিক ময়লা-আবর্জনা থেকেও পবিত্র রাখা। [ফাতহুল কাদীর] ইবরাহীম আলাইহিস সালাম-কে একথা বলার উদ্দেশ্য অন্য লোকদেরকে এ ব্যাপারে সচেষ্ট করা। কারণ, ইবরাহীম আলাইহিস সালাম নিজেই শির্ক ও কুফারী থেকে মুক্ত ছিলেন, তিনি আল্লাহর ঘরকে ময়লা-আবর্জনামুক্ত করতেন। এতদসত্ত্বেও যখন তাকে একাজ করতে বলা হয়েছে, তখন অন্যদের এ ব্যাপারে কতটুকু যত্নবান হওয়া উচিত, তা সহজেই অনুমেয়। আয়াত থেকে আরও স্পষ্ট হচ্ছে যে, এখানে কাবাঘরের সেবার দাবীদার তৎকালীন কাফের মুশরিকদের সাবধান করা হচ্ছে যে, এ ঘর নির্মাণের জন্য তোমাদের পিতার উপর শর্ত দেয়া হয়েছিল যে, তিনি এটাকে শির্কমুক্ত রাখবেন। তোমরা সে শর্তটি পূর্ণ করতে পারনি। বরং শির্ক দ্বারা কলুষিত করেছ। [ফাতহুল কাদীর] এ নির্দেশের সাথে কাদের জন্য ঘরটি পবিত্র রাখবেন তাদের কথাও জানিয়ে দেয়া হয়েছে। তারা হচ্ছেন, তাওয়াফকারী ও সালাতে দণ্ডায়মানকারী, রুকুকারী ও সিজদাকারী লোকদের জন্য। বিশেষ করে তাওয়াফ এ ঘর ছাড়া আর কোথাও জায়েয নেই, আর সালাত এ ঘর ব্যতীত অন্য কোন দিকে মুখ করে পড়া (নফল ও যুদ্ধের সময়কার সালাত ব্যতীত) জয়েয নেই। অনুরূপভাবে রুকু ও সিজদা বলার কারণে ইবাদাতের মধ্যে এ দু'টি রুকনের গুরুত্ব প্রকাশ পাচ্ছে। [ইবন কাসীর; ফাতহুল কাদীর]