ترجمة معاني سورة السجدة باللغة البنغالية من كتاب الترجمة البنغالية .
من تأليف: د. أبو بكر محمد زكريا .

আলিফ-লাম-মীম,
এ কিতাব সৃষ্টিকুলের রবের পক্ষ থেকে নাযিল হওয়া, এতে কোন সন্দেহ নেই [১]।
____________________
[১] এ কিতাব রাব্বুল আলামীনের পক্ষ থেকে নাযিল করা হয়েছে, শুধুমাত্র এতটুকু কথা বলেই এখানে শেষ করা হয়নি। বরং এর পরেও পূর্ণ জোরেশোরে বলা হয়েছে যে, এটা আল্লাহর কিতাব এবং আল্লাহর কাছ থেকে এর অবতীর্ণ হবার ব্যাপারে আদৌ কোন সন্দেহের অবকাশই নেই। [কুরতুবী, ফাতহুল কাদীরা]
নাকি তারা বলে, 'এটা সে নিজে রটনা করেছে [১]?' না, বরং তা আপনার রব হতে আগত সত্য, যাতে আপনি এমন এক সম্প্রদায়কে সতর্ক করতে পারেন, যাদের কাছে আপনার আগে কোন সতর্ককারী আসেনি [২], হয়তো তারা হিদায়াত লাভ করে।
____________________
[১] এটি নিছক প্রশ্ন ও জিজ্ঞাসা নয়। বরং এখানে মহাবিস্ময় প্রকাশের ভংগী অবলম্বন করা হয়েছে। [বাগভী]
[২] কাতাদাহ বলেন, তারা ছিল নিরক্ষর জাতি। মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর পূর্বে তাদের কাছে দূর অতীতে কোন সতর্ককারী আসে নি। [তাবারী।]
আল্লাহ্, যিনি আসমানসমূহ, যমীন ও এ দু’য়ের অন্তর্বর্তী সব কিছু সৃষ্টি করেছেন ছয় দিনে। তারপর তিনি আরশের উপর উঠেছেন। তিনি ছাড়া তোমাদের কোন অভিভাবক নেই ও সুপারিশকারীও নেই; তবুও কি তোমরা উপদেশ গ্রহণ করবে না?
তিনি আসমান থেকে যমীন পর্যন্ত সমুদয় বিষয় পরিচালনা করেন, তারপর সব কিছুই তাঁর সমীপে উত্থিত হবে এমন এক দিনে যার পরিমাণ হবে তোমাদের গণনা অনুসারে হাজার বছর [১]।
____________________
[১] অৰ্থাৎ সেদিনের পরিমাণ তোমাদের গণনানুসারে এক হাজার বছর হবে। কাতাদাহ বলেন, দুনিয়ার দিনের হিসেবে সে সময়টি হচ্ছে, এক হাজার বছর। তন্মধ্যে পাঁচশত বছর হচ্ছে নাযিল হওয়ার জন্য, আর পাঁচ শত বছর হচ্ছে উপরে উঠার জন্য। মোট: এক হাজার বছর। [তাবারী] অন্যত্র বলা হয়েছে, “সেদিনের পরিমাণ পঞ্চাশ হাজার বছর হবে।” [সূরা আল-মা'আরিজ:৪] এর এক সহজ উত্তর তো এই যে, সেদিনটি অত্যন্ত ভয়ঙ্কর হবে বিধায় মানুষের নিকট অতিশয় দীর্ঘ বলে মনে হবে। এরূপ দীর্ঘানুভূতি নিজ নিজ ঈমান ও আমলানুপাতে হবে। যারা বড় অপরাধী তাদের নিকট সুদীর্ঘ এবং যারা কম অপরাধী তাদের নিকট কম দীর্ঘ বলে বোধ হবে। এমনকি সেদিন কিছু লোকের নিকট এক হাজার বছর বলে মনে হবে, আবার কারো কারো নিকট পাঁচশত বছর বলে মনে হবে। আবার কারো কারো নিকট পঞ্চাশ হাজার বছর বলে মনে হবে। [তাবারী, বাগভী; ফাতহুল কাদীর]
তিনি, গায়েব ও উপস্থিত (যাবতীয় বিষয়ে) জ্ঞানী, প্রবল পরাক্রমশালী [১], পরম দয়ালু [২]।
____________________
[১] অর্থাৎ প্রত্যেকটি জিনিসের ওপর প্রাধান্যের অধিকারী। [মুয়াসসার]
[২] অৰ্থাৎ তিনি নিজের সৃষ্টির প্রতি দয়ার্দ্র ও করুণাময়। [ইবন কাসীর]
যিনি তাঁর প্রত্যেকটি সৃষ্টিকে সৃজন করেছেন উত্তমরূপে [১] এবং কাদা হতে মানব সৃষ্টির সূচনা করেছেন।
____________________
[১] অর্থাৎ তিনি যেভাবে সৃষ্টি করেছেন সেটাই উত্তম ও সুন্দর। [তাবারী] মুজাহিদ বলেন, তিনি প্রতিটি বস্তুর সৃষ্টি অত্যন্ত মজবুত ও নৈপুণ্য সহকারে সম্পন্ন করেছেন। [আত-তাফসীরুস সহীহ]
তারপর তিনি তার বংশ উৎপন্ন করেন তুচ্ছ তরল পদার্থের নির্যাস থেকে।
পরে তিনি সেটাকে করেছেন সুঠাম এবং তাতে ফুঁকে দিয়েছেন তাঁর রূহ থেকে। আর তোমাদেরকে দিয়েছেন কান, চোখ ও অন্তঃকরণ, তোমরা খুব সামান্যই কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর [১]।
____________________
[১] আয়াতের সমার্থে আরও দেখুন, সূরা আল-মুমিনুন: ১৩-১৪।
আর তারা বলে, 'আমরা মাটিতে হারিয়ে গেলেও কি আমরা হবো নূতন সৃষ্টি?' বরং তারা তাদের রবের সাক্ষাতের সাথে কুফরিকারী।
বলুন, 'তোমাদের জন্য নিযুক্ত মৃত্যুর ফেরেশতা তোমাদের প্রাণ হরণ করবে [১]। তারপর তোমাদের রবের কাছেই তোমাদেরকে ফিরিয়ে নেয়া হবে।'
____________________
[১] আলোচ্য আয়াতে “মালাকুল মাউত” এক বচনে বর্ণনা করা হয়েছে, অথচ অপর আয়াতে রয়েছে “ফেরেশতাগণ যাদের প্রাণ বিয়োগ ঘটায়”। [সূরা আল-আন’আমঃ ৬১] এতে এ ইঙ্গিত রয়েছে যে, “মালাকুল মাউত” একাকী এ কাজ সম্পন্ন করেন না; বহু ফেরেশতা তাঁর অধীনে এ কাজে অংশগ্রহণ করেন। [কুরতুবী, আদওয়াউল-বায়ান]
আর আপনি যদি দেখতেন! যখন অপরাধীরা তাদের রবের নিকট অবনত মস্তকে বলবে, 'হে আমাদের রব! আমরা দেখলাম ও শুনলাম, সুতরাং আপনি আমাদেরকে ফেরত পাঠান, আমরা সৎকাজ করব, নিশ্চয় আমরা দৃঢ়বিশ্বাসী [১]।'
____________________
[১] অন্য আয়াতে আল্লাহ জানিয়েছেন যে, তাদেরকে যদি ফেরৎ দেয়া হত, তবে তারা পুনরায় আল্লাহর দ্বীনের উপর মিথ্যারোপ করত। আল্লাহ বলেন, “আপনি যদি দেখতে পেতেন যখন তাদেরকে আগুনের উপর দাঁড় করান হবে তখন তারা বলবে, “হায়! যদি আমাদেরকে ফেরত পাঠান হত, আর আমরা আমাদের রবের আয়াতসমূহে মিথ্যারোপ না করতাম এবং আমরা মুমিনদের অন্তর্ভুক্ত হতাম।” বরং আগে তারা যা গোপন করত তা এখন তাদের কাছে প্রকাশ হয়ে গিয়েছে। আর তারা আবার ফিরে গেলেও তাদেরকে যা করতে নিষেধ করা হয়েছিল আবার তারা তাই করত এবং নিশ্চয়ই তারা মিথ্যাবাদী।” [সূরা আল-আন’আম: ২৭-২৮]
আর আমরা ইচ্ছে করলে প্রত্যেক ব্যক্তিকে তার হেদায়াত দিতাম [১]; কিন্তু আমার পক্ষ থেকে এ কথা অবশ্যই সাব্যস্ত যে, আমি নিশ্চয় কতেক জিন ও মানুষের সমন্বয়ে জাহান্নাম পূর্ণ করব।
____________________
[১] কাতাদাহ বলেন, যদি আল্লাহ চাইতেন তবে তারা সবাই ঈমান আনত। আর যদি আল্লাহ চাইতেন তবে তাদের উপর আসমান থেকে এমন কোন নিদর্শন নাযিল করতেন, যা দেখার পর তারা সবাই সেটার সামনে মাথা নত করে দিত। কিন্তু তিনি জোর করে ঈমানে নিয়ে আসতে চান না। কারণ, তাঁর কাছ থেকে তাদের উপর একটি বাণী সত্য হয়েছে যে, তিনি তাদের দিয়ে জাহান্নাম পূর্ণ করবেন। [তাবারী।]
কাজেই ‘শাস্তি আস্বাদন কর, কারণ তোমাদের এ দিনের সাক্ষাতের কথা তোমরা ভুলে গিয়েছিলে। আমরাও তোমাদেরকে পরিত্যাগ করলাম [১]। আর তোমরা যা আমল করতে তার জন্য তোমরা স্থায়ী শাস্তি ভোগ করতে থাক।'
____________________
[১] এখানে نسي শব্দের অর্থ পরিত্যাগ করা, ছেড়ে যাওয়া। আরবী ভাষায় এ শব্দটি ভুলে যাওয়া, ছেড়ে দেয়া এ দুটি অর্থেই ব্যবহৃত হয়। [তাবারী; কুরতুবী]
শুধু তারাই আমাদের আয়াতসমূহের উপর ঈমান আনে, যারা সেটার দ্বারা উপদেশপ্রাপ্ত হলে সিজ্‌দায় লুটিয়ে পড়ে এবং তাদের রবের সপ্রশংস পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করে, আর তারা অহংকার করে না।
তাদের পার্শ্বদেশ শয্যা হতে দূরে থাকে [১] তারা তাদের রবকে ডাকে আশংকা ও আশায় [২] এবং আমরা তাদেরকে যে রিযিক দান করেছি তা থেকে তারা ব্যয় করে।
____________________
[১] অর্থাৎ আয়েশ-আরাম করে রাত কাটাবার পরিবর্তে তারা নিজেদের রবের ইবাদাত করে। তাদের অবস্থা এমনসব দুনিয়াপূজারীদের মতো নয় যাদের দিনের পরিশ্রমের কষ্ট দূর করার জন্য রাতে নাচ-গান, শরাব পান ও খেলা তামাশার মতো আমোদ প্রমোদের প্রয়োজন হয়। এর পরিবর্তে তাদের অবস্থা হচ্ছে এই যে, সারা দিন নিজেদের দায়িত্ব পালন করে কাজ শেষে এসে দাঁড়ায় তারা নিজেদের রবের সামনে। তাঁকে স্মরণ করে রাত কাটিয়ে দেয়। তাঁর ভয়ে কাঁপতে থাকে এবং তাঁর কাছেই নিজেদের সমস্ত আশা-আকাংখা সমৰ্পণ করে। [দেখুন, মুয়াসসার, কুরতুবী, বাগভী]
[২] আয়াতে মুমিনগণের এক গুণ এই বলে বর্ণনা করা হয়েছে যে, তাদের শরীরের পার্শ্বদেশ শয্যা থেকে আলাদা থাকে এবং শয্যা পরিত্যাগ করে আল্লাহর যিকর ও দো'আয় আত্মনিয়োগ করে। কেননা, এরা মহান আল্লাহর অসন্তুষ্টি ও শাস্তিকে ভয় করে এবং তাঁর করুণা ও পূণ্যের আশা করে থাকে। আশা-নিরাশাপূর্ণ এ অবস্থা তাদেরকে যিকর ও দো’আর জন্য ব্যাকুল করে রাখে। অধিকাংশ মুফাসসিরগণের মতে শয্যা পরিত্যাগ করে যিকর ও দো'আয় আত্মনিয়োগ করার অর্থ তাহাজ্জুদ ও নফল সালাত যা ঘুম থেকে উঠার পর গভীর রাতে পড়া হয়। হাদীসের অপরাপর বর্ণনা থেকেও এর সমর্থন পাওয়া যায়। মা'আয ইবনে জাবাল রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি একদা নবীজীর সঙ্গে সফরে ছিলাম, সফরকালে একদিন আমি আরজ করলাম; ইয়া রাসূলাল্লাহ, আমাকে এমন কোন আমল বলে দিন যার মাধ্যমে আমি জান্নাত লাভ করতে পারি এবং জাহান্নাম থেকে অব্যাহতি পেতে পারি। তিনি বললেন, তুমি তো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বস্তু প্রার্থনা করেছ। কিন্তু আল্লাহ পাক যার জন্যে তা সহজ করে দেন তার পক্ষে তা লাভ করা অতি সহজ। অতঃপর বললেন, সে আমল এই যে, আল্লাহর ইবাদাত করবে এবং তাঁর সাথে কোন অংশীদার স্থাপন করবে না। সালাত প্রতিষ্ঠা করবে, যাকাত প্ৰদান করবে, সাওম রাখবে এবং বায়তুল্লাহ শরীফের হজ সম্পন্ন করবে। অতঃপর তিনি বললেন, এসো, তোমাকে পুণ্য দ্বারের সন্ধান দিয়ে দেই, (তা এই যে,) সাওম হচ্ছে ঢাল স্বরূপ (যা শাস্তি থেকে মুক্তি দেয়)। আর সদকা মানুষের পাপানল নির্বাপিত করে দেয়। অনুরূপভাবে মানুষের গভীর রাতের সালাত; এই বলে কোরআন মজীদের উল্লেখিত আয়াত তেলাওয়াত করেন। [তিরমিয়ী: ২৬১৬, ইবনে মাজাহঃ ৩৯৭৩, মুসনাদে আহমাদ: ৫/২৩১]
সাহাবী আবুদ্দারদা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু, প্রখ্যাত তাবেয়ী কাতাদাহ ও যাহহাক রাহেমাহুমাল্লাহ বলেন যে, সেসব লোকও শয্যা থেকে শরীরের পার্শ্বদেশ পৃথক হয়ে থাকা গুণের অধিকারী, যারা এশা ও ফজর উভয় সালাত জামা'আতের সাথে আদায় করেন। প্রখ্যাত সাহাবী আনাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত আছে, উল্লেখিত আয়াত যারা এশার সালাতের পূর্বে শয্যা গ্ৰহণ না করে, এশার জামাতের জন্য প্রতীক্ষারত থাকেন, তাদের সম্পর্কেই নাযিল হয়েছে। [আবু দাউদ: ১৩২১, তিরমিয়ী: ৩১৯৬] ইবনে-কাসীর ও অন্যান্য তাফসীরকারগণ বলছেন যে, এসব বক্তব্যের মধ্যে পরস্পর কোন বিরোধ নেই। প্রকৃতপক্ষে এরা সকলেই এ আয়াতের অন্তর্ভুক্ত। এর মধ্যে শেষরাতের সালাতই সর্বোত্তম ও সর্বশ্রেষ্ঠ মর্যাদার অধিকারী।
অতএব কেউই জানে না তাদের জন্য চোখ জুড়ানো কী লুকিয়ে রাখা হয়েছে তাদের কৃতকর্মের পুরস্কারস্বরূপ [১]!
____________________
[১] হাদীসে কুদসীতে উদ্ধৃত হয়েছে যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেনঃ “আল্লাহ বলেন, আমার সৎকর্মশীল বান্দাদের জন্য আমি এমনসব জিনিস তৈরী করে রেখেছি যা কখনো কোন চোখ দেখেনি, কোন কান শোনেনি এবং কোন মানুষ কোনদিন তা কল্পনাও করতে পারে না।” [বুখারী: ৪৭৭৯; মুসলিম: ১৮৯, ২৪২৪] হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, মূসা আলাইহিস সালাম আল্লাহকে বললেন, জান্নাতে কার অবস্থানগত মর্যাদা সবচেয়ে সামান্য হবে? তিনি বললেন, সে এক ব্যক্তি, তাকে সমস্ত জান্নাতীরা জান্নাতে প্রবেশ করার পরে জান্নাতের নিকট নিয়ে আসা হবে। তাকে বলা হবে, জান্নাতে প্রবেশ কর। সে বলবে, হে রব! সবাই তাদের স্থান নিয়ে নিয়েছে। তারা তাদের যা নেবার তা নিয়েছে। তখন তাকে বলা হবে, তুমি কি সন্তুষ্ট হবে, যদি তোমাকে দুনিয়ার বাদশাদের রাজত্বের মত রাজত্ব দেয়া হয়? সে বলবে, হে রব! আমি সন্তুষ্ট। তখন তাকে বলা হবে, তোমার জন্য তা-ই রইল, আরও অনুরূপ, আরও অনুরূপ, আরও অনুরূপ, আরও অনুরূপ। পঞ্চম বারে আল্লাহ বলবেন, তুমি কি সস্তুষ্ট হয়েছ? সে বলবে, হে রব! আমি সন্তুষ্ট। তখন তিনি বলবেন, এটা তোমার জন্য, তাছাড়া অনুরূপ দশগুণ। আর তোমার জন্য থাকবে তাতে যা তোমার মন চায়, তোমার চোখ শান্তি করে, সে বলবে, হে রব! আমি সন্তুষ্ট। সে বলবে, হে রব! (এই যদি আমার অবস্থা হয়) তবে জান্নাতে সর্বোচ্চ মর্যাদার অধিকারীর কি অবস্থা? তিনি বলবেন, তাদের জন্য আমি নিজ হাতে তাদের সম্মানের বীজ বপন করেছি, আর তাতে আমার মোহর মেরে দিয়েছি। সুতরাং কোন চোখে দেখেনি, কোন কান শুনেনি, আর কোন মানুষের মনে তা উদিত হয়নি। তারপর তিনি উপরোক্ত আয়াত তেলাওয়াত করলেন [মুসলিম: ১৮৯] অন্য হাদীসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “যে কেউ জান্নাতে যাবে নেয়ামত প্রাপ্ত হবে, সে কোনদিন নিরাশ হবে না, তার কাপড় পুরনো হবে না, আর তার যৌবন নিঃশেষ হবে না।” [মুসলিম: ২৮৩৬]
সুতরাং যে ব্যক্তি মুমিন, সে কি তার ন্যায় যে ফাসেক [১]? তারা সমান নয়।
____________________
[১] এখানে মুমিন ও ফাসেকের দু'টি বিপরীতমুখী পরিভাষা ব্যবহার করা হয়েছে। মুমিন বলতে এমন লোক বুঝানো হয়েছে, যে আল্লাহকে নিজের রব ও একমাত্র উপাস্য মেনে নিয়ে আল্লাহ তাঁর নবী-রাসূলদের মাধ্যমে যে আইন-কানুন পাঠিয়েছেন তার আনুগত্য করে। পক্ষান্তরে ফাসেক হচ্ছে এমন এক ব্যক্তি যে ফাসেকী আনুগত্য থেকে বের হয়ে আসা বা অন্যকথায় বিদ্রোহ, বল্লাহীন স্বেচ্ছাচারী মনোবৃত্তি ও আল্লাহ ছাড়া অন্য সত্তার আনুগত্যের নীতি অবলম্বন করে। [দেখুন, তাবারী, কুরতুবী]
যারা ঈমান আনে এবং সৎকাজ করে, তাদের কৃতকর্মের ফলসরূপ তাদের আপ্যায়নের জন্য রয়েছে জান্নাতের বাসস্থান।
আর যারা নাফরমানী করে, তাদের বাসস্থান হবে আগুন; যখনই তারা তা থেকে বের হতে চাইবে, তখনই তাদেরকে তাতে ফিরিয়ে দেয়া হবে, এবং তাদেরকে বলা হবে, 'যে আগুনের শাস্তিতে তোমরা মিথ্যারোপ করতে, তা আস্বাদন কর।'
আর অবশ্যই আমরা তাদেরকে মহা শাস্তির পূর্বে কিছু লঘু শাস্তি আস্বাদন করাব [১], যাতে তারা ফিরে আসে।
____________________
[১] নিকটতম শাস্তি বা “ছোট শাস্তি” বলে বোঝানো হয়েছে, এ দুনিয়ায় মানুষ যেসব কষ্ট পায় সেগুলো। যেমন, ব্যক্তিগত জীবনে কঠিন রোগ, নিজের প্রিয়তম লোকদের মৃত্যু, ভয়াবহ দুর্ঘটনা, মারাত্মক ক্ষতি, ব্যর্থতা ইত্যাদি। আর বৃহত্তর শাস্তি বা “বড় শাস্তি” বলতে আখেরাতের শাস্তি বোঝানো হয়েছে। কুফারী ও ফাসেকীর অপরাধে এ শাস্তি দেয়া হবে। [মুয়াসসার]
যে ব্যক্তি তার রবের আয়াতসমূহ দ্বারা উপদেশপ্রাপ্ত হয়ে তা থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়, তার চেয়ে বড় যালিম আর কে? নিশ্চয় আমরা অপরাধীদের থেকে প্রতিশোধ গ্রহণকারী।
আর অবশ্যই আমরা মুসাকে কিতাব দিয়েছিলাম, অতএব আপনি তার সাক্ষাত সম্বন্ধে সন্দেহে থাকবেন না [১] এবং আমরা ওটাকে করে দিয়েছিলাম বনী ইসরাঈলের জন্য হিদায়াতস্বরূপ।
____________________
[১] لقاء শব্দের অর্থ সাক্ষাৎ। এ আয়াতে কার সাথে সাক্ষাৎ বোঝানো হয়েছে সে সম্বন্ধে মুফাসসিরগণের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। لقا ىٔه এর ه (সর্বনাম) কিতাব অর্থাৎ কুরআনের দিকে ধাবিত করে এই অর্থ করা যায় যে, যেরূপভাবে মহান আল্লাহ মুসা আলাইহিস সালামকে গ্ৰন্থ প্রদান করেছেন অনুরূপভাবে আপনার প্রতিও আল্লাহ পাকের পক্ষ থেকে গ্ৰন্থ অবতীর্ণ হওয়া সম্পর্কে কোন সন্দেহ পোষণ করবেন না। যেমন কুরআন সম্পর্কে অন্য এক আয়াতে বলা হয়েছে, “এবং নিশ্চয় আপনাকে প্রজ্ঞাময় প্রশংসিতের পক্ষ থেকে কুরআন প্রদান করা হবে”। [সূরা আন-নামল: ৬] ইবনে-আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা এবং কাতাদাহ রাহেমাহুল্লাহ এর ব্যাখ্যা এভাবে করেছেন যে, لقا ىٔه এর ه (সর্বনাম) মুসা আলাইহিস সালাম এর দিকে ধাবিত হয়েছে। সে হিসেবে এ আয়াতে মুসা আলাইহিস সালাম এর সাথে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাক্ষাতের সংবাদ দেয়া হয়েছে এবং বলা হয়েছে যে, আপনি এ সম্পর্কে কোন সন্দেহ পোষণ করবেন না যে, মূসা আলাইহিস সালামের সাথে আপনার সাক্ষাত সংঘটিত হবে। সুতরাং মে'রাজের রাতে এক সাক্ষাৎকার সংঘটিত হওয়ার কথা বিশুদ্ধ হাদীসসমূহ দ্বারা প্রমাণিত; [দেখুন, বুখারী:৩২৩৯; মুসলিম:১৬৫] অতঃপর কেয়ামতের দিন সাক্ষাৎকার অনুষ্ঠিত হওয়ার কথাও প্রমাণিত আছে। হাসান বসরী রাহেমাহুল্লাহ এর ব্যাখ্যা এভাবে করেছেন যে, মূসা আলাইহিস সালামকে ঐশী গ্রন্থ প্রদানের দরুন যেভাবে মানুষ তাঁকে নানাভাবে দুঃখ-যন্ত্রণা দিয়েছে আপনিও এসব কিছুর সম্মুখীন হবেন বলে নিশ্চিত থাকুন। তাই কাফেরদের প্রদত্ত দুঃখ-যন্ত্রণার ফলে আপনি মনক্ষুন্ন হবেন না; বরং নবীগণের ক্ষেত্রে এমনটি হওয়া স্বাভাবিক রীতি মনে করে আপনি তা বরদাশত করুন।
আর আমরা তাদের মধ্য থেকে বহু নেতা মনোনীত করেছিলাম, যারা আমাদের নির্দেশ অনুসারে হেদায়াত করত; যেহেতু তারা ধৈর্য ধারণ করেছিল। আর তারা আমাদের আয়াতসমূহে দৃঢ় বিশ্বাস রাখত [১]।
____________________
[১] অর্থাৎ আমি ইসরাঈল সম্প্রদায়ের মাঝে কিছু লোককে নেতা ও অগ্রপথিক নিযুক্ত করেছিলাম যারা তাঁদের পয়গম্বরের প্রতিনিধি হিসাবে মহান প্রভুর নির্দেশানুসারে লোকদেরকে হেদায়াত করতেন। [দেখুন, মুয়াসসার]
নিশ্চয় আমাদের রব, যে বিষয়ে তারা মতবিরোধ করছে তিনি কিয়ামতের দিন তাদের মধ্যে সেটার ফায়সালা করে দিবেন।
এটাও কি তাদেরকে হেদায়াত করলো না যে, আমরা তাদের পূর্বে ধ্বংস করেছি বহু প্রজন্মকে ---যাদের বাসভূমিতে তারা বিচরণ করে থাকে? নিশ্চয় এতে প্রচুর নিদর্শন রয়েছে; তবুও কি তারা শুনবে না?
তারা কি লক্ষ্য করে না যে, আমরা শুকনো ভূমির [১] উপর পানি প্রবাহিত করে, তার সাহায্যে উদ্‌গত করি শস্য, যা থেকে আহার্য গ্রহণ করে তাদের চতুষ্পদ জন্তু এবং তারা নিজেরাও? তারপরও কি তারা লক্ষ্য করবে না [২]?
____________________
[১] অর্থাৎ তারা কি লক্ষ্য করে না যে, আমি শুষ্ক ভূমিতে পানি প্রবাহিত করি যদ্বারা নানা প্রকারের শস্যাদি উদগত হয়। الْاَرْضِ الْخْرُزِ শুষ্ক ভূমিকে বলা হয় যেখানে কোন বৃক্ষলতা উদগত হয় না। ইবন আব্বাস বলেন, এখানে এমন ভূমির কথা বলা হচ্ছে, যে ভূমিতে অল্প পানি পড়লে কোন কাজে লাগে না। তবে সেখানে যদি প্রবল বর্ষণের পানি আসে। তবেই সেটা কাজে লাগে। [তাবারী।]
[২] শুষ্ক ভূমিতে পানি প্রবাহে; এবং সেখানে নানাবিধ উদ্ভিদ ও তরু-লতা উদগত হওয়ার বর্ণনা পবিত্র কুরআনের বিভিন্ন জায়গায় এভাবে করা হয়েছে যে, ভূমিতে বৃষ্টি বর্ষিত হয়। ফলে ভূমি রসালো হয়ে শস্যাদি উৎপাদনের যোগ্য হয়ে উঠে। কিন্তু এ আয়াতে বৃষ্টির স্থলে ভূ-পৃষ্ঠের উপর দিয়ে শুষ্ক ভূমির দিকে পানি প্রবাহিত করে গাছপালা উদগত করার কথা বর্ণনা করা হয়েছে। অর্থাৎ অন্য কোন ভূমির উপর বৃষ্টি বর্ষণ করে সেখান থেকে নদী-নালার মাধ্যমে ভূ-পৃষ্ঠের উপর দিয়ে যেসব শুষ্ক ভূ-ভাগে সাধারণত বৃষ্টি হয় না সেদিকে প্রবাহিত করা হয়। [কুরতুবী; সা’দী]
আর তারা বলে, 'তোমরা যদি সত্যবাদী হও, তবে বল, কখন হবে এ বিজয় [১]?'
____________________
[১] তাফসীরকার মুজাহিদ আলোচ্য আয়াতে বিজয় এর অর্থ কেয়ামতের দিন বলে বর্ণনা করেছেন। [ইবন কাসীর; বাগভী] কাতাদাহ বলেন, এখানে فتح বলে বিচার ফয়সালাই বোঝানো হয়েছে। [আত-তাফসীরুস সহীহ] আল্লামা শানকীতী বলেন, কারণ, কুরআনের বহু আয়াতে এ শব্দটি বিচার-ফয়সালা অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। যেমন শু'আইব আলাইহিস সালাম এর যাবানীতে এসেছে, “হে আমাদের রব! আমাদের ও আমাদের সম্পপ্রদায়ের মধ্যে ন্যায্যভাবে মীমাংসা করে দিন এবং আপনিই শ্রেষ্ঠ মীমাংসাকারী।” [সূরা আল-আশরাফ: ১৮৯] [আদওয়াউল বায়ান]
বলুন, 'বিজয়ের দিন কাফিরদের ঈমান আনা তাদের কোন কাজে আসবে না এবং তাদেরকে অবকাশও দেয়া হবে না [১]'।
____________________
[১] অর্থাৎ যখন আল্লাহর আযাব এসে যাবে এবং তাঁর ক্ৰোধ আপতিত হবে, তখন কাফেরদের ঈমান কোন কাজে আসবে না। আর তাদেরকে তখন আর কোন সুযোগও দেয়া হবে না। যেমন অন্য আয়াতে এসেছে, “অতঃপর তাদের কাছে যখন স্পষ্ট প্রমাণাদিসহ তাদের রাসূলগণ আসলেন, তখন তারা নিজেদের কাছে বিদ্যমান থাকা জ্ঞানে উৎফুল্ল হল। আর তারা যা নিয়ে ঠাট্টা-বিদ্রুপ করত তা-ই তাদেরকে বেষ্টন করল। অতঃপর তারা যখন আমাদের শাস্তি দেখল তখন বলল, ‘আমরা একমাত্র আল্লাহর উপর ঈমান আনলাম এবং আমরা তাঁর সাথে যাদেরকে শরীক করতাম তাদের সাথে কুফরী করলাম।’ কিন্তু তারা যখন আমার শাস্তি দেখল তখন তাদের ঈমান তাদের কোন উপকারে আসল না। আল্লাহর এ বিধান পূর্ব থেকেই তাঁর বান্দাদের মধ্যে চলে আসছে এবং তখনই কাফিররা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।" [সূরা গাফির: ৮৩-৮৫]
অতএব আপনি তাদেরকে উপেক্ষা করুন এবং অপেক্ষা করুন, তারাও তো অপেক্ষামান [১]।
____________________
[১] যেমন অন্য আয়াতে এসেছে, “নাকি তারা বলে, ‘সে একজন কবি? আমরা তার মৃত্যুর প্রতীক্ষা করছি। বলুন, ‘তোমরা প্রতীক্ষা কর, আমিও তোমাদের সাথে প্রতীক্ষাকারীদের অন্তর্ভুক্ত।” [সূরা আত-তুর: ৩০-৩১]