ﰡ
____________________
[১] خلد শব্দের অর্থ মারা। [ফাতহুল কাদীর] خلد শব্দ দ্বারা ব্যক্ত করার মধ্যে ইঙ্গিত আছে যে, এই বেত্ৰাঘাতের প্রতিক্রিয়া চামড়া পর্যন্তই সীমিত থাকা চাই এবং মাংস পর্যন্ত না পৌঁছা চাই। [বাগভী] একশ' বেত্ৰাঘাতের উল্লেখিত শাস্তি শুধু অবিবাহিত পুরুষ ও নারীর জন্য নির্দিষ্ট; বিবাহিতদের শাস্তি প্রস্তরাঘাতে হত্যা করা। [সা‘দী] হাদীসে এসেছে, দু’জন লোক রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে এসে বিবাদে লিপ্ত হলো। তাদের একজন বললঃ আপনি আমাদের মাঝে আল্লাহ্র কিতাব দিয়ে ফয়সালা করে দিন। অপরজন-যে তাদের মধ্যে তুলনামূলকভাবে জ্ঞানী ছিল সে-বললোঃ হ্যাঁ, হে আল্লাহ্র রাসূল! আপনি আমাদের মাঝে ফয়সালা করে দিন এবং আমাকে কথা বলার অনুমতি দিন। তিনি বললেনঃ বল। লোকটি বললঃ আমার ছেলে এ লোকের কাজ করতো। তারপর সে তার স্ত্রীর সাথে ব্যভিচার করে বসে। লোকেরা আমাকে বললো যে, আমার ছেলের উপর পাথর মেরে হত্যা করার হুকুম রয়েছে। তখন আমি একশত ছাগল এবং একটি দাসীর বিনিময়ে আমার ছেলেকে ছাড়িয়ে আনি। তারপর আমি জ্ঞানীদের জিজ্ঞেস করলে তারা বললো যে, আমার সন্তানের উপর ১০০ বেত্ৰাঘাত এবং একবছরের দেশান্তর। পাথর মেরে হত্যা তো তার স্ত্রীর উপরই। তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ তোমার ছাগল ও দাসী তোমার কাছে ফেরৎ যাবে। তারপর তিনি তার ছেলেকে ১০০ বেত্ৰাঘাত এবং এক বছরের দেশান্তরের শাস্তি দিলেন। এবং উনাইস রাদিয়াল্লাহু আনহুকে বললেনঃ এ দ্বিতীয় ব্যাক্তির স্ত্রীর নিকট যাও। যদি সে স্বীকারোক্তি দেয় তবে তাকে পাথর মেরে হত্যা কর। পরে মহিলা স্বীকারোক্তি করলে তাকে পাথর মেরে হত্যা করা হয়। [বুখারীঃ ৬৬৩৩, ৬৬৩৪, মুসলিমঃ ১৬৯৭, ১৬৯৮] অনুরূপভাবে উমর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লামের মিম্বরে উপবিষ্ট অবস্থায় বললেনঃ আল্লাহ্ তা‘আলা মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সত্যসহ প্রেরণ করেন এবং তার প্রতি কিতাব নাযিল করেন। কিতাবে যেসব বিষয় নাযিল করা হয়, তন্মধ্যে প্রস্তরাঘাতে হত্যার বিধানও ছিল, যা আমরা পাঠ করেছি, স্মরণ রেখেছি এবং হৃদয়ঙ্গম করেছি। অতঃপর রাসূল সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লামও প্রস্তরাঘাতে হত্যা করেছেন এবং তার পরে আমরাও করেছি। এখন আমি আশংকা করছি যে, সময়ের চাকা আবর্তিত হওয়ার পর কেউ একথা বলতে না শুরু করে যে, আমরা প্রস্তরাঘাতে হত্যার বিধান আল্লাহ্র কিতাবে পাই না। ফলে সে একটি দ্বীনী কর্তব্য পরিত্যাগ করার কারণে পথভ্রষ্ট হয়ে যাবে, যা আল্লাহ্ তা‘আলা নাযিল করেছেন। মনে রেখো, প্রস্তরাঘাতে হত্যার বিধান আল্লাহ্র কিতাবে সত্য এবং বিবাহিত পুরুষ ও নারীর প্রতি প্রযোজ্য- যদি ব্যভিচারের শরীয়তসম্মত সাক্ষ্য-প্রমাণ উপস্থিত হয় অথবা গর্ভ ও স্বীকারোক্তি পাওয়া যায় । [বুখারীঃ ৬৮২৯, মুসলিমঃ ১৬৯১]
[২] ব্যভিচারের শাস্তি অত্যন্ত কঠোর বিধায় শাস্তি প্রয়োগকারীদের তরফ থেকে দয়াপরবশ হয়ে শাস্তি ছেড়ে দেয়ার কিংবা হ্রাস করার সম্ভাবনা আছে। [সা‘দী] তাই সাথে সাথে আদেশ দেয়া হয়েছে যে, দ্বীনের এই গুরুত্বপূর্ণ বিধান কার্যকর করণে অপরাধীদের প্রতি দয়াপরবশ হওয়া বৈধ নয়। [দেখুন, ইবন কাসীর, বাগভী, তাবারী]
[৩] অর্থাৎ ঘোষণা দিয়ে সাধারণ লোকের সামনে শাস্তি দিতে হবে। এর ফলে একদিকে অপরাধী অপদস্ত হবে এবং অন্যদিকে সাধারণ মানুষ শিক্ষা লাভ করবে। [ফাতহুল কাদীর, কুরতুবী, সা‘দী]
____________________
[১] আলোচ্য আয়াতের তাফসীর প্রসঙ্গে তাফসীরবিদদের বিভিন্ন উক্তি রয়েছে। কোন কোন তাফসীরকারক আয়াতটিকে মনসূখ তথা রহিত বলেন। তাদের মতে আয়াতের ভাষ্য হলো, ব্যভিচারী মহিলাকে বিয়ে করার ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা। [বাগভী] কোন কোন মুফাসসির এ হুকুমকে সুনির্দিষ্ট ঘটনার সাথে সম্পর্কযুক্ত মনে করেন। [দেখুন, ইবন কাসীর, কুরতুবী, বাগভী, ফাতহুল কাদীর] আব্দুল্লাহ ইবনে আমর ইবনুল ‘আস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেনঃ সে যুগে এক মহিলার নাম ছিল উম্মে মাহযুল। সে যিনা করত (বেশ্যা ছিল)। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লামের এক সাহাবী তাকে বিয়ে করতে চাইলে আল্লাহ্ তা‘আলা এ আয়াত নাযিল করেন। [মুসনাদে আহমাদঃ ২/১৫৯, ২/২২৫, নাসায়ীঃ কিতাবুত-তাফসীর, হাদীস নং- ৩৭৯, মুস্তাদরাকে হাকেমঃ ২/১৯৩-১৯৪), বায়হাকীঃ ৭/১৫৩] অনুরূপ অন্য এক বর্ণনায় এসেছে, সে যুগে ‘আনাক’ নাম্নী এক বেশ্যা ছিল, মারসাদ নামীয় এক সাহাবী তাকে বিয়ে করতে চাইলে এ আয়াত নাযিল হয়। [তিরমিযীঃ ৩১৭৭, আবু দাউদঃ ২০৫১, মুস্তাদরাকে হাকোমঃ ২/১৬৬]
[২] আয়াতের ذٰلِكَ শব্দ দ্বারা ব্যভিচারী ও ব্যভিচারিণীর বিয়ে এবং মুশরিক ও মুশরিকার বিয়ের দিকে ইশারা করা হয়েছে [দেখুন, কুরতুবী]
কোন নারী বা কোন পুরুষ যিনাকারী হিসাবে পরিচিত হলে যদি সেই কাজ থেকে তাওবাহ না করে তবে তাকে বিয়ে করা জায়েয নাই। [আয়সারুত-তাফাসির, সা‘দী] রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ ‘তিন ধরনের লোক জান্নাতে যাবে না। আল্লাহ্ তাদের দিকে কেয়ামতের দিন তাকাবেন না। (এক) পিতা-মাতার অবাধ্য, (দুই) পুরুষের মত চলাফেরাকারিণী মহিলা এবং (তিন) দায়্যূস (যে ব্যক্তি তার স্ত্রীর সাথে অপকর্ম হতে দেখেও তার আত্মমর্যাদাবোধ জাগ্রত হয় না)। [মুসনাদে আহমাদঃ ২/১৩৪, ইবনে হিব্বানঃ ৭৩৪০]
____________________
[১] محصنات শব্দটি إحصان থেকে উদ্ভুত। শরীয়তের পরিভাষায় إحصان ‘ইহসান’ দুই প্রকার। একটি ব্যভিচারের শাস্তির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য এবং অপরটি অপবাদ আরোপের শাস্তির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। ব্যভিচারের শাস্তির ক্ষেত্রে إحصان এই যে, যার বিরুদ্ধে ব্যভিচার প্রমাণিত হয়, তাকে জ্ঞান সম্পন্ন, বালেগ, মুক্ত ও মুসলিম হতে হবে এবং শরীয়ত সম্মত পন্থায় কোন নারীকে বিয়ে করে তার সাথে সঙ্গমও হতে হবে। এরূপ ব্যাক্তি যিনা করলে তার প্রতি রজম তথা প্রস্তরাঘাতে হত্যার শাস্তি প্রয়োগ করা হবে। পক্ষান্তরে অপবাদ আরোপের শাস্তির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য إحصان এই যে, যে ব্যাক্তির প্রতি ব্যভিচারের অপবাদ আরোপ করা হয়, তাকে জ্ঞান সম্পন্ন বালেগ, মুক্ত ও মুসলিম হতে হবে, সৎ হতে হবে অর্থাৎ পূর্বে কখনো তার বিরুদ্ধে ব্যভিচার প্রমাণিত হয়নি। [দেখুন, কুরতুবী, বাগভী, সা‘দী, যাদুল মাসির]
[২] যে ব্যক্তি অন্যের বিরুদ্ধে যিনার অভিযোগ আনে, সে সাক্ষ্য-প্রমাণের মাধ্যমে নিজের অভিযোগ প্রমাণ করবে। আর যদি প্রমাণ করতে না পারে তাহলে তাকে আশি ঘা বেত্ৰাঘাত করো, যাতে ভবিষ্যতে আর সে কখনো এ ধরনের কোন কথা বিনা প্রমাণে নিজের মুখ থেকে বের করার সাহস না করে। আর তাদের সাক্ষ্য কখনো গ্রহণযোগ্য হবে না। [ইবন কাসীর, মুয়াসসার]
____________________
[১] যখন কোন স্বামী তার স্ত্রীর প্রতি ব্যভিচারের অপবাদ দেয় অথবা সন্তান সম্পর্কে বলে যে, সে আমার শুক্রজাত নয়, অপরপক্ষে স্ত্রী স্বামীকে মিথ্যাবাদী অভিহিত করে দাবী করে যে, তাকে মিথ্যা অপবাদের শাস্তি আশিটি বেত্ৰাঘাত প্ৰদান করা হোক, তখন স্বামীকে স্বপক্ষে চার জন সাক্ষী উপস্থিত করাতে বলা হবে। সে যদি যথাবিহিত চার জন সাক্ষী পেশ করে যারা স্ত্রীর ব্যভিচারের পক্ষে এমনভাবে সাক্ষ্য দিবে যে স্ত্রীর ব্যভিচার বিচারকের কাছে প্রমাণিত হয়ে পড়ে, তখন স্ত্রীর প্রতি ব্যভিচারের হদ প্রয়োগ করা হবে। পক্ষান্তরে সে চার জন সাক্ষী পেশ করতে না পারলে স্বামী-স্ত্রী উভয়ের মধ্যে লি‘আন করানো হবে। প্রথমে স্বামীকে বলা হবে যে, সে কুরআনে উল্লেখিত ভাষায় চার বার সাক্ষ্যদান করুক যে, সে এ ব্যাপারে সত্যবাদী এবং পঞ্চম বার বলুক যে, সে মিথ্যাবাদী হলে তার প্রতি আল্লাহ্র লা‘নত বা অভিশাপ বৰ্ষিত হবে।
স্বামী যদি এসব কথা থেকে বিরত থাকে, তবে যে পর্যন্ত নিজের মিথ্যাবাদী হওয়ার কথা স্বীকার না করে অথবা উপরোক্ত ভাষায় পাঁচ বার কসম না করে, সে পর্যন্ত তাকে আটক রাখা হবে। সে যদি মিথ্যাবাদী হওয়ার কথা স্বীকার করে, তবে তার উপর অপবাদের শাস্তি প্রয়োগ করা হবে। পক্ষান্তরে যদি পাঁচ বার কসম করে নেয়, তবে স্ত্রীর কাছ থেকেও কুরআনে বর্ণিত ভাষায় পাঁচ বার কসম করিয়ে নেয়া হবে। যদি সে কসম করতে অস্বীকার করে, তবে যে পর্যন্ত সে স্বামীর কথার সত্যতা স্বীকার না করে এবং নিজের ব্যভিচারের অপরাধ স্বীকার না করে, সে পর্যন্ত তাকে আটক রাখা হবে। আর এরূপ স্বীকারোক্তি করলে তার উপর ব্যভিচারের শাস্তি প্রয়োগ করা হবে। পক্ষান্তরে যদি উপরোক্ত ভাষায় কসম করতে সম্মত হয়ে যায় এবং কসম করে নেয়, তবে লি‘আন পূর্ণতা লাভ করবে। এর ফলশ্রুতিতে দুনিয়ার শাস্তির কবল থেকে উভয়েই বেঁচে যাবে। আখেরাতের ব্যাপার আল্লাহ্ তা‘আলাই জানেন যে, তাদের মধ্যে কে মিথ্যাবাদী। মিথ্যাবাদী আখেরাতের শাস্তি ভোগ করবে। কিন্তু দুনিয়াতেও যখন স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে লি‘আন হয়ে গেল, তখন তারা একে অপরের জন্য চিরতরে হারাম হয়ে যাবে। বিচারক উভয়ের মধ্যে বিচ্ছেদ ঘটিয়ে দেবেন। এটা তালাকেরই অনুরূপ হবে। এখন তাদের মধ্যে পুনর্বিবাহও হতে পারবে না। [ইবন কাসীর, কুরতুবী সা‘দী]
হাদীসের কিতাবাদিতে লি‘আন সংক্রান্ত দুটি ঘটনার উল্লেখ করা হয়েছে। একটি ঘটনা হেলাল ইবন উমাইয়া ও তার স্ত্রীর, যা সহীহ বুখারীতে আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমার বর্ণনায় রয়েছে। এ ঘটনার প্রাথমিক অংশ ইবনে আব্বাসেরই বর্ণনায় মুসনাদে আহমাদে এভাবে রয়েছে- ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা বলেনঃ যখন কুরআনে অপবাদের হদ সম্পর্কিত
وَالَّذِينَ يَرْمُونَ الْمُحْصَنَاتِ ثُمَّ لَمْ يَأْتُوا بِأَرْبَعَةِ شُهَدَاءَ فَاجْلِدُوهُمْ ثَمَانِينَ جَلْدَةً
আয়াত নাযিল হল, তখন মুসলিমদের মধ্যে কিছুটা চাঞ্চল্য দেখা দিল। কারণ এতে কোন নারীর প্রতি ব্যভিচারের অপবাদ আরোপকারী পুরুষের জন্য জরুরী করা হয়েছে যে, হয় সে স্বপক্ষে চার জন সাক্ষী উপস্থিত করবে, তন্মধ্যে এক জন সে নিজে হবে, না হয় তাকে মিথ্যাবাদী সাব্যস্ত করে আশিটি বেত্ৰাঘাত করা হবে এবং চিরতরে তার সাক্ষ্য প্রত্যাখ্যাত হবে। এ আয়াত শুনে আনসারদের সর্দার সা‘দ ইবনে উবাদা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বললেনঃ হে আল্লাহ্র রাসূল, এ আয়াতগুলো ঠিক এভাবেই নাযিল হয়েছে? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম সা‘দ ইবনে উবাদার মুখে এরূপ কথা শুনে বিস্মিত হলেন। তিনি আনসারদেরকে সম্বোধন করে বললেনঃ তোমরা কি শুনলে, তোমাদের সর্দার কি কথা বলছেন? আনসারগণ বললঃ হে আল্লাহ্র রাসূল, আপনি তাকে তিরস্কার করবেন না। তার একথা বলার কারণ তার তীব্র আত্মমর্যাদাবোধ। অতঃপর সা‘দ ইবনে উবাদা নিজেই বললেনঃ হে আল্লাহ্র রাসূল, আমার পিতা-মাতা আপনার প্রতি উৎসর্গ; আমার পুরোপুরি বিশ্বাস রয়েছে যে, আয়াতগুলো সত্য এবং আল্লাহ্ তা‘আলার পক্ষ থেকেই নাযিল করা হয়েছে। কিন্তু আমি আশ্চর্য বোধ করি যে, যদি আমি লজ্জাহীনা স্ত্রীকে এমতাবস্থায় দেখি যে, তার উপর ভিন্ন পুরুষ সওয়ার হয়ে আছে, তখন কি আমার জন্য বৈধ হবে না যে, আমি তাকে শাসন করি এবং সেখান থেকে সরিয়ে দেই; না আমার জন্য এটা জরুরী যে, আমি চার জন লোক এনে এটা দেখাই এবং সাক্ষী করি? যতক্ষণে আমি সাক্ষী সংগ্ৰহ করব, ততক্ষণে কি তারা উদ্দেশ্য সাধন করে পলায়ণ করবে না?
সা‘দ ইবনে উবাদার এ কথাবার্তার অল্পদিন পরেই একটি ঘটনা সংঘটিত হল। হেলাল ইবনে উমাইয়া এশার সময় ক্ষেত থেকে ফিরে এসে স্ত্রীর সাথে এক জন পুরুষকে স্বচক্ষে দেখলেন এবং তাদের কথাবার্তা নিজ কানে শুনলেন। কিন্তু কিছুই বললেন না। সকালে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে ঘটনা বর্ণনা করলে তিনি খুব দুঃখিত হলেন এবং ব্যাপারটিকে গুরুতর মনে করলেন। এদিকে আনসারগণ একত্রিত হয়ে বলতে লাগল যে, আমাদের সর্দার সা‘দ যে কথা বলেছিলেন, এক্ষণে আমরা তাতেই লিপ্ত হয়ে পড়লাম। এখন শরীয়তের আইন অনুযায়ী রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম হেলাল ইবনে উমাইয়াকে আশিটি বেত্ৰাঘাত করবেন এবং জনগণের মধ্যে চিরতরে তার সাক্ষ্য প্রত্যাখ্যাত হবে। কিন্তু হেলাল ইবনে উমাইয়া জোর দিয়ে বললেনঃ আল্লাহ্র কসম! আমার পূর্ণ বিশ্বাস যে, আল্লাহ্ তা ‘আলা আমাকে এই বিপদ থেকে উদ্ধার করবেন। বুখারীর বর্ণনায় আরো বলা হয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম হেলালের ব্যাপার শুনে কুরআনের বিধান মোতাবেক তাকে বলেও দিয়েছিলেন যে, হয় দাবীর স্বপক্ষে চার জন সাক্ষী উপস্থিত কর, না হয় তোমার পিঠে অপবাদের শাস্তিস্বরূপ আশিটি বেত্ৰাঘাত পড়বে। হেলাল উত্তরে বললেনঃ যিনি আপনাকে সত্যসহ প্রেরণ করেছেন তাঁর কসম, আমি আমার কথায় সত্যবাদী এবং আল্লাহ্ তা‘আলা অবশ্যই এমন কোন বিধান নাযিল করবেন, যা আমার পিঠকে অপবাদের শাস্তি থেকে মুক্ত করে দেবে। [বুখারীঃ ৪৭৪৭, ৫৩০৭] এই কথাবার্তা চলছিল এমতাবস্থায় জিবরাঈল ‘আলাইহিস সালাম লি‘আনের আইন সম্বলিত আয়াত নিয়ে নাযিল হলেন’ অৰ্থাৎ
وَالَّذِينَ يَرْمُونَ اَزْوَاخَهُمْ
আবু ইয়ালা এই বর্ণনাটিই আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণনা করেছেন। এতে আরো বলা হয়েছে যে, লি‘আনের আয়াত নাযিল হওয়ার পর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম হেলাল ইবনে উমাইয়াকে সুসংবাদ দিলেন যে, আল্লাহ্ তা‘আলা তোমার সমস্যার সমাধান নাযিল করেছেন। হেলাল বললেনঃ আমি আল্লাহ্ তা‘আলার কাছে এই আশাই পোষণ করেছিলাম। অতঃপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম হেলালের স্ত্রীকে ডেকে আনলেন। স্বামী-স্ত্রীর উপস্থিতিতে স্ত্রীর জবানবন্দী নেয়া হল। সে বললঃ আমার স্বামী হেলাল ইবনে উমাইয়া আমার প্রতি মিথ্যা অপবাদ আরোপ করেছেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ তোমাদের মধ্যে একজন যে মিথ্যাবাদী, তা আল্লাহ্ তা‘আলা জানেন। জিজ্ঞাস্য এই যে, তোমাদের কেউ কি আল্লাহ্র আযাবের ভয়ে তাওবাহ করবে এবং সত্য কথা প্রকাশ করবে? হেলাল বললেনঃ আমার পিতা-মাতা আপনার প্রতি উৎসর্গ; আমি সম্পূর্ণ সত্য কথা বলছি। তখন রাসূল সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম আয়াত অনুযায়ী উভয়কে লি‘আন করানোর আদেশ দিলেন। প্রথমে হেলালকে বলা হল যে, তুমি কুরআনের বর্ণিত ভাষায় চার বার সাক্ষ্য দাও; অর্থাৎ আমি আল্লাহ্কে সাক্ষী রেখে বিশ্বাস করে বলছি যে, আমি সত্যবাদী। হেলাল আদেশ অনুযায়ী চার বার সাক্ষ্য দিলেন। পঞ্চম সাক্ষ্যর কুরআনী ভাষা এরূপঃ “যদি আমি মিথ্যা বলি, তবে আমার প্রতি আল্লাহ্র লা‘নত বর্ষিত হবে।” এই সাক্ষ্যের সময় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম হেলালকে বললেনঃ দেখ হেলাল, আল্লাহ্কে ভয় কর। কেননা, দুনিয়ার শাস্তি আখেরাতের শাস্তির তুলনায় অনেক হাল্কা। আল্লাহ্র আযাব মানুষের দেয়া শাস্তির চাইতে অনেক কঠোর। এই পঞ্চম সাক্ষ্যই শেষ সাক্ষ্য। এর ভিত্তিতেই ফয়সালা হবে। কিন্তু হেলাল বললেনঃ আমি কসম করে বলতে পারি যে, আল্লাহ্ তা‘আলা আমাকে এই সাক্ষ্যের কারণে আখেরাতের আযাব দেবেন না। এরপর তিনি পঞ্চম সাক্ষ্যর শব্দগুলোও উচ্চারণ করে দিলেন। অতঃপর হেলালের স্ত্রীর কাছ থেকেও এমনি ধরণের চার সাক্ষ্য অথবা কসম নেয়া হল। পঞ্চম সাক্ষ্যর সময় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ একটু থাম। আল্লাহ্কে ভয় কর। এই সাক্ষ্যই শেষ সাক্ষ্য। আল্লাহ্র আযাব মানুষের আযাব অর্থাৎ ব্যভিচারের শাস্তির চাইতেও অনেক কঠোর। এ কথা শুনে সে কসম করতে ইতস্ততঃ করতে লাগল। এ অবস্থায় কিছুক্ষণ অতিবাহিত হলে অবশেষে সে বললঃ আল্লাহ্র কসম আমি আমার গোত্রকে চিরদিনের জন্য লাঞ্ছিত করব না। অতঃপর সে পঞ্চম সাক্ষ্যও একথা বলে দিয়ে দিল যে, আমার স্বামী সত্যবাদী হলে আমার উপর আল্লাহ্র গজব বা ক্ৰোধ আপতিত হবে। এভাবে লি‘আনের কার্যধারা সমাপ্ত হয়ে গেলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম স্বামী-স্ত্রীকে বিচ্ছিন্ন করে দিলেন অর্থাৎ তাদের বিয়ে নাকচ করে দিলেন। তিনি আরো ফয়সালা দিলেন যে, এই গৰ্ভ থেকে যে সন্তান জন্মগ্রহণ করবে, সে এই স্ত্রীর সন্তান বলে কথিত হবে- পিতার সাথে সম্বন্ধযুক্ত হবে না। কিন্তু সন্তানটিকে ধিকৃতও করা হবে না। [মুসনাদে আহমাদঃ ১/২৩৮-২৩৯, আবু দাউদঃ ২২৫৬, আবু ইয়া‘লাঃ ২৭৪০]
বুখারী ও মুসলিমে সাহল ইবনে সা‘দ সায়েদীর বর্ণনা এভাবে আছে যে, ওয়াইমের আজলানী রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে বললেনঃ হে আল্লাহ্র রাসূল, যদি কেউ তার স্ত্রীকে ভিন্ন পুরুষের সাথে দেখে, তবে সে কি তাকে হত্যা করবে, যার ফলে তাকেও হত্যা করা হবে? বা তার কি করা উচিত? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ আল্লাহ্ তা‘আলা তোমার এবং তোমার স্ত্রীর ব্যাপারে বিধান নাযিল করেছেন। যাও স্ত্রীকে নিয়ে এস। বর্ণনাকারী সাহল বলেনঃ তাদেরকে এনে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম মসজিদের মধ্যে লি‘আন করালেন। যখন উভয় পক্ষ থেকে পাঁচটি সাক্ষ্য পূর্ণ হয়ে লি‘আন সমাপ্ত হল, তখন ওয়াইমের বললেনঃ হে আল্লাহ্র রাসূল, এখন যদি আমি তাকে স্ত্রীরূপে রাখি, তবে এর অর্থ এই হয় যে, আমি তার প্রতি মিথ্যা অপবাদ আরোপ করেছি। তারপর তিনি তাকে তালাক দিয়ে দিলেন। [বুখারীঃ ৪৭৪৫, ৪৭৪৬, ৫৩০৯, মুসলিমঃ ১৪৯২]
আলোচ্য ঘটনাদ্বয়ের মধ্য থেকে প্রত্যেকটি সম্পর্কে বলা হয়েছে যে, লি‘আনের আয়াত এরই পরিপ্রেক্ষিতে নাযিল হয়েছে। হাফেয ইবনে হাজার ও ইমাম বগভী উভয়ের মধ্যে সামঞ্জস্য বিধানকল্পে বলেছেন যে, মনে হয় প্রথম ঘটনা হেলাল ইবনে উমাইয়ার ছিল এবং লি‘আনের আয়াত এরই পরিপ্রেক্ষিতে নাযিল হয়েছে। এরপর ওয়াইমের এমনি ধরণের ঘটনার সম্মুখীন হয়। হেলাল ইবনে উমাইয়ার ঘটনা তার জানা ছিল না। কাজেই এ ব্যাপারটি যখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে পেশ করা হল তখন তিনি বললেনঃ তোমার ব্যাপারে ফয়সালা এই। এর স্বপক্ষে ইঙ্গিত এই যে, হেলাল ইবনে উমাইয়ার ঘটনায় হাদীসের ভাষা হচ্ছে فَنَزَلَ جِبْرَىِٔيْلُ এবং ওয়াইমেরের ঘটনায় ভাষা হচ্ছে قَلْ نَزَّلَ اللّٰهُ فِيْكَ এর অর্থ এরূপও হতে পারে যে, আল্লাহ্ তা‘আলা তোমার অনুরূপ এক ঘটনায় এর বিধান নাযিল করেছেন।
উপরোক্ত দু’টি বর্ণনা ছাড়াও লি‘আন সংক্রান্ত আরো কিছু হাদীস এসেছে যেগুলো থেকে লি‘আনের গুরুত্বপূর্ণ মাসআলা সাব্যস্ত হয়েছে। যেমন, ইবন উমর রাদিয়াল্লাহু আনহুমা বলেন, স্বামী-স্ত্রী লি‘আন শেষ করার পর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদের মধ্যে ছাড়াছাড়ি করে দেন। [বুখারীঃ ৫৩০৬, ৪৭৪৮; মুসনাদে আহমদঃ ২/৫৭] ইবনে উমরের অন্য এক বর্ণনায় বলা হয়েছে, এক ব্যক্তি ও তার স্ত্রীর মধ্যে লি‘আন করানো হয়। তারপর স্বামীটি গর্ভের সন্তান অস্বীকার করে। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদের মধ্যে ছাড়াছাড়ি করে দেন এবং ফায়সালা শুনিয়ে দেন, সন্তান হবে শুধুমাত্র মায়ের। [বুখারীঃ ৫৩১৫, ৬৭৪৮] ইবনে উমরের আর একটি বর্ণনায় এসেছে যে, উভয়ে লি‘আন করার পর রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, “তোমাদের হিসাব এখন আল্লাহ্র জিম্মায়। তোমাদের একজন অবশ্যই মিথ্যুক।” তারপর তিনি পুরুষটিকে বলেন, এখন এ আর তোমার নয়। তুমি এর উপর নিজের কোন অধিকার দেখাতে পারো না। এর উপর কোনরকম হস্তক্ষেপও করতে পারো না। অথবা এর বিরুদ্ধে অন্য কোন প্রকার প্রতিশোধমূলক পদক্ষেপ গ্ৰহণ করার অধিকারও আর তোমার নেই। পুরুষটি বলে, হে আল্লাহ্র রসূল! আর আমার সম্পদ? (অর্থাৎ যে মোহরানা আমি তাকে দিয়েছিলাম তা আমাকে ফেরত দেবার ব্যবস্থা করুন)। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, “সম্পদ ফেরত নেবার কোন অধিকার তোমার নেই। যদি তুমি তার উপর সত্য অপবাদ দিয়ে থাকো তাহলে ঐ সম্পদ সে আনন্দ উপভোগের প্রতিদান যা তুমি হালাল করে তার থেকে লাভ করেছো। আর যদি তুমি তার উপর মিথ্যা অপবাদ দিয়ে থাকো তাহলে সম্পদ তোমার কাছ থেকে আরো অনেক দূরে চলে গেছে। তার তুলনায় তোমার কাছ থেকে তা বেশী দূরে রয়েছে।” [বুখারীঃ ৫৩৫০] অপর বর্ণনায় আলী ইবন আবু তালেব ও ইবন মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহুমা বলেনঃ “সুন্নাত এটিই নির্ধারিত হয়েছে যে, লি‘আনকারী স্বামী-স্ত্রী পরবর্তী পর্যায়ে আর কখনো বিবাহিতভাবে একত্র হতে পারে না।” [দারু কুতনী ৩/২৭৬] আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস থেকে বর্ণিত আছে তিনি বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, এরা দু’জন আর কখনো একত্র হতে পারে না। [দারুকুতুনীঃ ৩/২৭৬] লি‘আনের উপযুক্ত আয়াত এবং এ হাদীসগুলোর আলোকে ফকীহগণ লি‘আনের বিস্তারিত আইন-কানুন তৈরী করেছেন। এ আইনের গুরুত্বপূর্ণ ধারাগুলো হচ্ছেঃ
একঃ যে ব্যাক্তি স্ত্রীর ব্যভিচার স্বচক্ষে দেখে লি‘আনের পথ অবলম্বন না করে হত্যা করে বসে তার ব্যাপারে মতভেদ রয়েছে। একটি দল বলে, তাকে হত্যা করা হবে। কারণ নিজের উদ্যোগে ‘হদ’ জারি করার তথা আইন হাতে তুলে নেয়ার অধিকার তার ছিল না। দ্বিতীয় দল বলে, তাকে হত্যা করা হবে না এবং তার কর্মের জন্য তাকে জবাবদিহিও করতে হবে না, তবে এ ক্ষেত্রে শর্ত হচ্ছে তার দাবীর সত্যতা প্রমাণিত হতে হবে (অর্থাৎ যথার্থই সে তার যিনার কারণে এ কাজ করেছে)। ইমাম আহমদ ও ইসহাক ইবনে রাহওয়াইহ বলেন, এটিই হত্যার কারণ এ মর্মে তাকে দু’জন সাক্ষী আনতে হবে। মালেকীদের মধ্যে ইবনুল কাসেম ও ইবনে হাবীব এ মর্মে অতিরিক্ত শর্ত আরোপ করেন যে, যাকে হত্যা করা হয়েছে সেই যিনাকারীর বিবাহিত হতে হবে। অন্যথায় কুমার যিনাকারীকে হত্যা করলে তার কাছ থেকে কিসাস নেয়া হবে। কিন্তু অধিকাংশ ফকীহের মতে তাকে কিসাস থেকে শুধুমাত্র তখনই মাফ করা হবে যখন সে যিানার চারজন সাক্ষী পেশ করবে অথবা নিহত ব্যাক্তি মরার আগে নিজ মুখে একথা স্বীকার করে যাবে যে, সে তার স্ত্রীর সাথে যিনা করছিল এবং এ সংগে নিহত ব্যক্তিকে বিবাহিতও হতে হবে।
দুইঃ ঘরে বসে লি‘আন হতে পারে না। এ জন্য আদালতে যাওয়া জরুরী।
তিনঃ লি‘আন দাবী করার অধিকার শুধু স্বামীর নয়, স্ত্রীরও। স্বামী যখন তার উপর যিনার অপবাদ দেয় অথবা তার শিশুর বংশধারা মেনে নিতে অস্বীকার করে তখন স্ত্রী আদালতে গিয়ে লি‘আন দাবী করতে পারে।
চারঃ সব স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে কি লি‘আন হতে পারে অথবা এ জন্য তাদের দু’জনের মধ্যে কি কিছু শর্ত পাওয়া যেতে হবে? এ বিষয়ে ফকীহদের মধ্যে মতভেদ দেখা যায়। ইমাম শাফেঈ বলেন, যার কসম আইনের দিক দিয়ে নির্ভরযোগ্য এবং যার তালাক দেবার ক্ষমতা আছে সে লি‘আন করতে পারে। প্ৰায় একই ধরনের অভিমত ইমাম মালেক ও ইমাম আহমাদেরও। কিন্তু হানাফীগণ বলেন, লি‘আন শুধুমাত্র এমন স্বাধীন মুসলিম স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে হতে পারে যারা কাযাফের অপরাধে শাস্তি পায়নি। যদি স্বামী ও স্ত্রী দু’জনই কাফের, দাস বা কাযাফের অপরাধে পূর্বেই শাস্তি প্রাপ্ত হয়ে থাকে, তাহলে তাদের মধ্যে লি‘আন হতে পারে না। এ ছাড়াও যদি স্ত্রীর এর আগেও কখনো হারাম বা সন্দেহযুক্ত পদ্ধতিতে কোন পুরুষের সাথে মাখামাখি থেকে থাকে, তাহলে এ ক্ষেত্রেও লি‘আন ঠিক হবে না।
পাঁচঃ নিছক ইশারা-ইংগিত, রূপক, উপমা বা সন্দেহ-সংশয় প্রকাশের ফলে লি‘আন অনিবার্য হয়ে পড়ে না। বরং কেবলমাত্র এমন অবস্থায় তা অনিবার্য হয় যখন স্বামী দ্ব্যর্থহীন ভাষায় যিানার অপবাদ দেয় অথবা সুস্পষ্ট ভাষায় সন্তানকে নিজের বলে মেনে নিতে অস্বীকার করে।
ছয়ঃ যদি অপবাদ দেবার পর স্বামী কসম খেতে ইতঃস্তত করে বা ছলনার আশ্রয় নেয় তাহলে ইমাম আবু হানীফার মতে, তাকে বন্দী করতে হবে এবং যতক্ষণ সে লি‘আন না করে অথবা নিজের অপবাদকে মিথ্যা বলে না মেনে নেয় ততক্ষণ তাকে মুক্তি দেয়া হবে না। আর মিথ্যা বলে মেনে নিলে তার বিরুদ্ধে কাযাফের দণ্ড জারি হয়ে যাবে। এর বিপরীতপক্ষে ইমাম মালেক, শাফেঈ এর মতে, লি‘আন করতে ইতঃস্তত করার ব্যাপারটি নিজেই মিথ্যার স্বীকারোক্তি। ফলে কসম করতে ইতঃস্তত করলেই তার উপর কাযাফের হদ ওয়াজিব হয়ে যায়।
সাতঃ স্বামীর কসম খাওয়ার পর স্ত্রী যদি লি‘আন করতে ইতঃস্তত করে, তাহলে হানাফীদের মতে তাকে বন্দী করতে হবে এবং ততক্ষণ পর্যন্ত তাকে মুক্তি দেয়া যাবে না যতক্ষণ না সে লি‘আন করবে অথবা যিানার স্বীকারোক্তি না করে নেবে। অন্যদিকে উপরোক্ত ইমামগণ বলেন, এ অবস্থায় তাকে রজম করে দেয়া হবে। তারা কুরআনের ঐ উক্তি থেকে যুক্তি পেশ করেন যে, একমাত্র কসম খাওয়ার পরই স্ত্রী শাস্তি মুক্ত হবে। এখন যেহেতু সে কসম খাচ্ছে না, তাই নিশ্চিতভাবেই সে শাস্তির যোগ্য হবে।
আটঃ যদি লি‘আনের সময় স্ত্রী গর্ভবতী থাকে তাহলে ইমাম আহমাদের মতে স্বামী গৰ্ভস্থত সন্তানকে গ্ৰহণ করতে অস্বীকার করুক বা না করুক স্বামীর গর্ভস্থত সন্তানের দায়মুক্ত হবার এবং সন্তান তার ঔরষজাত গণ্য না হবার জন্য লি‘আন নিজেই যথেষ্ট। ইমাম শাফেঈ বলেন, স্বামীর যিনার অপবাদ ও গর্ভস্থত সন্তানের দায়িত্ব অস্বীকার করা এক জিনিস নয়। এ জন্য স্বামী যতক্ষণ গৰ্ভস্থত সন্তানের দায়িত্ব গ্রহণ করতে সুস্পষ্টভাবে অস্বীকার না করবে ততক্ষণ তা যিানার অপবাদ সত্ত্বেও তার ঔরষজাত গণ্য হবে। কারণ স্ত্রী যিনাকারিনী হওয়ার ফলেই বর্তমান গৰ্ভজাত সন্তানটি যে যিানার কারণে জন্ম নিয়েছে, এটা অপরিহার্য নয়।
নয়ঃ ইমাম মালেক, ইমাম শাফেঈ, ইমাম আহমাদ স্ত্রীর গর্ভধারণকালে স্বামীকে গৰ্ভস্থত সন্তান অস্বীকার করার অনুমতি দিয়েছেন এবং এরই ভিত্তিতে লি‘আনকে বৈধ বলেন। কিন্তু ইমাম আবু হানীফা বলেন, যদি স্বামীর অপবাদের ভিত্তি যিনা না হয়ে থাকে বরং শুধু এটাই হয়ে থাকে যে, সে স্ত্রীকে এমন অবস্থায় গর্ভবতী পেয়েছে যখন তার মতে এ গর্ভস্থত সন্তান তার হতে পারে না তখন এ অবস্থায় লি‘আনের বিষয়টিকে সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়া পর্যন্ত মূলতবী করে দেয়া উচিত। কারণ অনেক সময় কোন কোন রোগের ফলে গৰ্ভ সঞ্চার হয়েছে বলে সন্দেহ দেখা দেয় কিন্তু প্রকৃতপক্ষে গর্ভসঞ্চার হয় না।
দশঃ যদি পিতা সন্তানের বংশধারা অস্বীকার করে তাহলে লি‘আন অনিবাৰ্য হয়ে পড়ে, এ ব্যাপারে সবাই একমত। আবার এ ব্যাপারেও সবাই একমত যে, একবার সন্তানকে গ্ৰহণ করে নেবার পর পিতার পক্ষে আর তার বংশধারা অস্বীকার করার অধিকার থাকে না। এ অবস্থায় পিতা বংশধারা অস্বীকার করলে কাযাফের শাস্তির অধিকারী হবে।
এগারঃ যদি স্বামী তালাক দেওয়ার পর সাধারণভাবে তালাকপ্ৰাপ্তা স্ত্রীর বিরুদ্ধে যিনার অপবাদ দেয় তাহলে ইমাম আবু হানীফার মতে লি‘আন হবে না। বরং তার বিরুদ্ধে কাযাফের মামলা দায়ের করা হবে। কারণ লি‘আন হচ্ছে স্বামী-স্ত্রীর জন্য। আর তালাকপ্ৰাপ্তা নারীটি তার স্ত্রী নয়। তবে যদি রজ‘ঈ তালাক হয় এবং রুজু করার (স্ত্রীকে ফিরিয়ে নেবার) সময়-কালের মধ্যে সে অপবাদ দেয়, তাহলে ভিন্ন কথা।
বারঃ লি‘আনের আইনগত ফলাফলের মধ্য থেকে কোন কোনটার ব্যাপারে সবাই একমত আবার কোন কোনটার ব্যাপারে ফকীহগণের মধ্যে মতানৈক্য সৃষ্টি হয়েছে। যেসব ফলাফলের ব্যাপারে মতৈক্য হয়েছে সেগুলো হচ্ছেঃ লি‘আন অনুষ্ঠিত হলে স্বামী ও স্ত্রী উভয়েই কোন শাস্তি লাভের উপযুক্ত হবে না। স্বামী যদি সন্তানের বংশধারা অস্বীকার করে তাহলে সন্তান হবে একমাত্র মায়ের। সন্তান বাপের সাথে সম্পর্কিত হবে না এবং তার উত্তরাধিকারীও হবে না। মা তার উত্তরাধিকারী হবে এবং সে মায়ের উত্তরাধিকারী হবে।
নারীকে ব্যভিচারিনী এবং তার সন্তানকে জারজ সন্তান বলার অধিকার কারোর থাকবে না। যদিও লি‘আনের সময় তার অবস্থা এমন পর্যায়ে পৌঁছে যায় যার ফলে তার ব্যাভিচারিনী হবার ব্যাপারে কারোর মনে সন্দেহ না থাকে, তবুও তাকে ও তার সন্তানকে একথা বলার অধিকার থাকবে না।
যে ব্যাক্তি লি‘আনের পরে তার অথবা তার সন্তানের বিরুদ্ধে আগের অপবাদের পুনরাবৃত্তি করবে সে ‘হদে’র যোগ্য হবে।
নারীর মোহরানা বাতিল হয়ে যাবে না।
ইদ্দত পালনকালে নারী পুরুষের থেকে খোরপোশ ও বাসস্থানের সুবিধা লাভের হকদার হবে না।
নারী ঐ পুরুষের জন্য হারাম হয়ে যাবে।
তাছাড়া, দু’টি বিষয়ে মতভেদ রয়েছে। এক, লি‘আনের পরে পুরুষ ও নারী কিভাবে আলাদা হবে? এ বিষয়ে ইমাম শাফেঈ বলেন, যখনই পুরুষ লি‘আন শেষ করবে, নারী জবাবী লি‘আন করুক বা না করুক তখনই সংগে সংগেই ছাড়াছড়ি হয়ে যাবে। ইমাম মালেক, লাইস ইবনে সা’দ ও যুফার বলেন, পুরুষ ও নারী উভয়েই যখন লি‘আন শেষ করে তখন ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়। অন্যদিকে ইমাম আবু হানীফা, আবু ইউসুফ ও মুহাম্মাদ বলেন, লি‘আনের ফলে ছাড়াছাড়ি আপনা আপনি হয়ে যায় না বরং আদালত ছাড়াছাড়ি করে দেবার ফলেই ছাড়াছাড়ি হয়। যদি স্বামী নিজেই তালাক দিয়ে দেয় তাহলে ভালো, অন্যথায় আদালতের বিচারপতি তাদের মধ্যে ছাড়াছাড়ি করার কথা ঘোষণা করবেন। দুই, লি‘আনের ভিত্তিতে আলাদা হয়ে যাবার পর কি তাদের উভয়ের আবার মিলিত হওয়া সম্ভব? এ বিষয়টিতে ইমাম মালেক, আবু ইউসুফ, শাফেঈ, আহমাদ ইবন হাম্বল বলেন, লি‘আনের মাধ্যমে যে স্বামী-স্ত্রী আলাদা হয়ে গেছে তারা এরপর থেকে চিরকালের জন্য পরস্পরের উপর হারাম হয়ে যাবে। তারা পুনর্বার পরস্পর বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে চাইলেও কোন অবস্থাতেই পারবে না। উমর, আলী ও আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমও এ একই মত পোষণ করেন। বিপরীত পক্ষে সা‘ঈদ ইবন মুসাইয়েব, ইবরাহীম নাখাঈ, শা‘বী, সাঈদ ইবনে জুবাইর, আবু হানীফা ও মুহাম্মাদ রাহেমাহুমুল্লাহর মতে, যদি স্বামী নিজের মিথ্যা স্বীকার করে নেয় এবং তার উপর কাযাফের হদ জারি হয়ে যায় তাহলে তাদের দু’জনের মধ্যে পুর্নবার বিয়ে হতে পারে। তারা বলেন, তাদের উভয়কে পরস্পরের জন্য হারামকারী জিনিস হচ্ছে লি‘আন। যতক্ষণ তারা এর উপর প্রতিষ্ঠিত থাকবে ততক্ষণ হারামও প্রতিষ্ঠিত থাকবে কিন্তু যখনই স্বামী নিজের মিথ্যা স্বীকার করে নিয়ে শাস্তি লাভ করবে তখনই লি‘আন খতম হয়ে যাবে এবং হারামও নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। [দেখুন, কুরতুবী]
____________________
[১] এখানে বাক্যের বাকী অংশ উহ্য আছে। কারণ, এখানে অনেক কিছুই বর্ণিত হয়েছে যদি আল্লাহ্র রহমত ও অনুগ্রহ না থাকত তবে অনেক কিছুই ঘটে যেতে পারত। যদি আল্লাহ্র রহমত ও অনুগ্রহ হিসেবে এ আয়াতসমূহ নাযিল না করা হতো তবে এ সমস্ত বিষয় মানুষের জীবনকে বিপর্যস্ত করে দিত। যদি আল্লাহ্র রহমত না হতো তবে কেউ নিজেদেরকে তাওবার মাধ্যমে পবিত্র করার সুযোগ পেত না। যদি আল্লাহ্র রহমত না হতো তবে তাদের মধ্যে যারা মিথ্যাবাদী তাদের উপর লা‘নত বা গজব নাযিল হয়েই যেত। এ সমস্ত সম্ভাবনার কারণেই আল্লাহ্ তা‘আলা এখানে উত্তরটি উহ্য রেখেছেন। [দেখুন, তাবারী, বাগভী, ফাতহুল কাদীর]
____________________
[১] পূর্বেই বর্ণিত হয়েছে যে, সূরা আন-নূরের অধিকাংশ আয়াত চারিত্রিক নিষ্কলুষতা ও পবিত্ৰতা সংরক্ষণের জন্য প্রবর্তিত বিধানাবলীর সাথে সম্পর্কযুক্ত। এর বিপরীতে চারিত্রিক নিষ্কলুষতা ও পবিত্রতার উপর অবৈধ হস্তক্ষেপ ও এর বিরুদ্ধাচরণের জাগতিক শাস্তি ও আখেরাতের মহা বিপদের কথা আলোচনা করা হয়েছে। তাই পরম্পরায় প্রথমে ব্যভিচারের শাস্তি, তারপর অপবাদের শাস্তি ও পরে লি‘আনের কথা বর্ণিত হয়েছে। অপবাদের শাস্তি সম্পর্কে চার জন সাক্ষীর অবর্তমানে কোন পবিত্ৰা নারীর প্রতি অপবাদ আরোপ করাকে মহাপাপ সাব্যস্ত করা হয়েছে। এরূপ অপবাদ আরোপকারীর শাস্তি আশিটি বেত্ৰাঘাত প্রবর্তন করা হয়েছে। এ বিষয়টি সাধারণ মুসলিম পবিত্ৰা নারীদের সাথে সম্পৃক্ত ছিল। ষষ্ট হিজরীতে কতিপয় মুনাফেক উন্মুল মুমিনীন আয়েশা সিদ্দীকা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহার প্রতি এমনি ধরণের অপবাদ আরোপ করেছিল এবং তাদের অনুসরণ করে কয়েকজন মুসলিমও এ আলোচনায় জড়িত হয়ে পড়েছিলেন। ব্যাপারটি সাধারণ মুসলিম সচ্চরিত্রা নারীদের পক্ষে অত্যাধিক গুরুতর ছিল। তাই কুরআনুল কারীমে আল্লাহ্ তা‘আলা আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহার পবিত্ৰতা বর্ণনা করে এ স্থলে উপরোক্ত দশটি আয়াত নাযিল করেছেন। [ইবন কাসীর] এসব আয়াতে আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহার পবিত্ৰতা ঘোষণা করতঃ তার ব্যাপারে যারা কুৎসা রটনা ও অপপ্রচারে অংশগ্রহণ করেছিল, তাদের সবাইকে হুশিয়ার করা হয়েছে এবং দুনিয়া ও আখেরাতে তাদের বিপদ বর্ণনা করা হয়েছে। এই অপবাদ রটনার ঘটনাটি কুরআন ও হাদীসে ‘ইফকের ঘটনা’ নামে খ্যাত। ইফক শব্দের অর্থ জঘন্য মিথ্যা অপবাদ। [বাগভী] এসব আয়াতের তাফসীর বুঝার জন্য অপবাদের কাহিনীটি জেনে নেয়া অত্যন্ত জরুরী। তাই প্ৰথমে সংক্ষেপে কাহিনীটি বর্ণনা করা হচ্ছে।
বিভিন্ন হাদীস গ্রন্থে এই ঘটনাটি অসাধারণ দীর্ঘ ও বিস্তারিত আকারে উল্লেখ করা হয়েছে। এর সংক্ষিপ্ত বর্ণনা এই যে, ষষ্ঠ হিজরীতে যখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম বনী মুস্তালিক নামান্তরে মুরাইসী যুদ্ধে গমন করেন, তখন স্ত্রীদের মধ্য থেকে আয়েশা সিদ্দীকা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা সাথে ছিলেন। ইতিপূর্বে নারীদের পর্দার বিধান নাযিল হয়েছিল। তাই আয়েশা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহার উটের পিঠে পর্দাবিশিষ্ট আসনের ব্যবস্থা করা হয়। আয়েশা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা প্রথমে পর্দাবিশিষ্ট আসনে সওয়ার হয়ে যেতেন। এরপর লোকেরা আসনটিকে উটের পিঠে বসিয়ে দিত। এটাই ছিল নিত্যকার নিয়ম। যুদ্ধ সমাপ্তির পর মদীনায় ফেরার পথে একদিন একটি ঘটনা ঘটল। এক মনযিলে কাফেলা অবস্থান করার পর শেষ রাতে প্রস্থানের কিছু পূর্বে ঘোষণা করা হল যে, কাফেলা কিছুক্ষণের মধ্যেই এখান থেকে রওয়ানা হয়ে যাবে। তাই প্ৰত্যেকেই যেন নিজ নিজ প্রয়োজন সেরে প্রস্তুত হয়। আয়েশা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা প্রয়োজন সারতে জঙ্গলের দিকে চলে গেলেন। সেখানে ঘটনাক্রমে তার গলার হার ছিঁড়ে কোথাও হারিয়ে গেল। তিনি সেখানে হারটি খুঁজতে লাগলেন। এতে বেশ কিছু সময় অতিবাহিত হয়ে গেল। অতঃপর স্বস্থানে ফিরে এসে দেখলেন যে, কাফেলা রওয়ানা হয়ে গেছে। রওয়ানা হওয়ার সময় আয়েশা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহার আসনটি যথারীতি উটের পিঠে সওয়ার করিয়ে দেয়া হয়েছে এবং বাহকরা মনে করেছে যে, তিনি ভেতরেই আছেন। এমনকি উঠানোর সময়ও সন্দেহ হল না। কারণ, তিনি তখন অল্পবয়স্কা ক্ষীণাঙ্গিণী ছিলেন। ফলে আসনটি যে শূণ্য এরূপ ধারণাও কারো মনে উদয় হল না। আয়েশা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা ফিরে এসে যখন কাফেলাকে পেলেন না, তখন অত্যন্ত বুদ্ধিমত্তা ও স্থিরচিত্ততার পরিচয় দিলেন এবং কাফেলার পশ্চাতে দৌড়াদৌড়ি করা কিংবা এদিক-ওদিক খুঁজে দেখার পরিবর্তে স্বস্থানে চাদর গায়ে জড়িয়ে বসে রইলেন। তিনি মনে করলেন যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তার সঙ্গীগণ যখন জানতে পারবেন যে, আমি আসনে অনুপস্থিত তখন আমার খোঁজে তারা এখানে আসবেন। কাজেই আমি এদিক-সেদিক চলে গেলে তাদের জন্য আমাকে খুঁজে বের করা মুশকিল হয়ে যাবে। সময় ছিল শেষ রাত, তাই তিনি কিছুক্ষণের মধ্যেই নিদ্রার কোলে ঢলে পড়লেন।
অপরদিকে সফওয়ান ইবনে মুয়াত্তাল রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ কাজের জন্য নিযুক্ত করেছিলেন যে, তিনি কাফেলার পশ্চাতে সফর করবেন এবং কাফেলা রওয়ানা হয়ে যাওয়ার পর কোন কিছু পড়ে থাকলে তা কুড়িয়ে নেবেন। তিনি সকাল বেলায় এখানে পৌঁছলেন। তখন পর্যন্ত প্রভাত-রশ্মি ততটুকু উজ্জ্বল ছিল না। তিনি শুধু একজন মানুষকে নিদ্রামগ্ন দেখতে পেলেন। কাছে এসে আয়েশা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহাকে চিনে ফেললেন। কারণ, পর্দা সংক্রান্ত আয়াত নাযিল হওয়ার পূর্বে তিনি তাকে দেখেছিলেন। চেনার পর অত্যন্ত বিচলিত কণ্ঠে তার মুখ থেকে ইন্নালিল্লাহি ওয়াইন্নাইলাইহি রাজি‘উন’ উচ্চারিত হয়ে গেল। এই বাক্য আয়েশা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহার কানে পৌছার সাথে সাথে তিনি জাগ্রত হয়ে গেলেন এবং মুখমণ্ডল ঢেকে ফেললেন। সফওয়ান নিজের উট কাছে এনে বসিয়ে দিলেন। আয়েশা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা তাতে সওয়ার হয়ে গেলেন এবং সফওয়ান রাদিয়াল্লাহু আনহু নিজে উটের নাকের রশি ধরে পায়ে হেঁটে চলতে লাগলেন। অবশেষে তিনি কাফেলার সাথে মিলিত হয়ে গেলেন।
আব্দুল্লাহ ইবনে উবাই ছিল দুশ্চরিত্র, মুনাফেক ও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শত্রু। সে একটা সুবর্ণ সুযোগ পেয়ে গেল। এই হতভাগা আবোল-তাবোল বকতে শুরু করল। কিছুসংখ্যক সরল-প্রাণ মুসলিমও কানকথায় সাড়া দিয়ে এ আলোচনায় মেতে উঠল। পুরুষদের মধ্যে হাসসান ইবনে সাবিত, মিস্তাহ ইবনে আসাল এবং নারীদের মধ্যে হামনাহ বিনতে জাহাশ ছিল এ শ্রেণীভুক্ত।
যখন এই মুনাফেক-রটিত অপবাদের চর্চা হতে লাগল, তখন স্বয়ং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম এতে খুবই মর্মাহত হলেন। আয়েশা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহার তো দুঃখের সীমাই ছিল না। সাধারণ মুসলিমগণও তীব্রভাবে বেদানাহত হলেন। একমাস পর্যন্ত এই আলোচনা চলতে লাগল। অবশেষে আল্লাহ্ তা‘আলা উন্মুল মু’মিনীন আয়েশা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহার পবিত্রতা বর্ণনা এবং অপবাদ রটনাকারী ও এতে অংশগ্রহণকারীদের নিন্দা করে উপরোক্ত আয়াতসমূহ নাযিল করলেন। অপবাদের হদ-এ বর্ণিত কুরআনী-বিধান অনুযায়ী অপবাদ আরোপকারীদের কাছ থেকে সাক্ষ্য তলব করা হল। তারা এই ভিত্তিহীন খবরের সাক্ষ্য কোথা থেকে আনবে? ফলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম শরীয়তের নিয়মানুযায়ী তাদের প্রতি অপবাদের হদ প্রয়োগ করলেন। প্রত্যেককে আশিটি বেত্ৰাঘাত করা হল। [আবু দাউদের বর্ণনায়, তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম তিন জন মুসলিম মিসতাহ, হামানাহ ও হাসসানের প্রতি হদ প্রয়োগ করেন। [আবু দাউদঃ ৪৪৭৪] অতঃপর মুসলিমরা তাওবাহ করে নেয় এবং মুনাফেকরা তাদের অবস্থানে কায়েম থাকে। তবে আব্দুল্লাহ ইবনে উবাইকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম শাস্তি দিয়েছেন প্রমাণিত হয়নি। যদিও তাবরানী কয়েকজন সাহাবী থেকে বর্ণনা করেছেন যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে শাস্তি দিয়েছেন। [দেখুন- মু‘জামুল কাবীরঃ ২৩/১৪৬(২১৪), ২৩/১৩৭(১৮১), ২৩/১২৫(১৬৪), ২৩/১২৪(১৬৩)]
[২] عُصْبَةٌ শব্দের অর্থ দশ থেকে চল্লিশ জন পর্যন্ত লোকের দল। এর কমবেশীর জন্যও এই শব্দ ব্যবহৃত হয়। [দেখুন-ইবন কাসীর, কুরতুবী, ফাতহুল কাদীর]
[৩] অর্থাৎ যারা এই অপবাদে যতটুকু অংশ নিয়েছে, তাদের জন্য সে পরিমাণ গোনাহ লেখা হয়েছে এবং সে অনুপাতেই তাদের শাস্তি হবে। [বাগভী]
[৪] উদ্দেশ্য এই যে, যে ব্যাক্তি অপবাদে বড় ভূমিকা নিয়েছে অর্থাৎ একে রচনা করে চালু করেছে, তার জন্য গুরুতর আযাব রয়েছে। বলাবাহুল্য, এ ব্যক্তি হচ্ছে মুনাফেক আব্দুল্লাহ ইবনে উবাই। [মুয়াসসার]
____________________
[১] এ আয়াতের দু’টি অনুবাদ হতে পারে। এক, যখন তোমরা শুনেছিলে তখনই কেন মু’মিন পুরুষ ও মু’মিন নারীরা নিজেদের সম্পর্কে সুধারণা করেনি? অন্য একটি অনুবাদ এও হতে পারে, নিজেদের লোকদের অথবা নিজেদের সমাজের লোকদের ব্যাপারে ভালো ধারণা করনি কেন? আয়াতের শব্দাবলী দু’ধরনের অর্থের অবকাশ রাখে। অর্থাৎ তোমরা যখন এই অপবাদের সংবাদ শুনলে, তখন মুসলিম পুরুষ ও নারী নিজেদের মুসলিম ভাই-বোনদের সম্পর্কে সুধারণা করলে না কেন এবং একথা বললে না কেন যে, এটা প্ৰকাশ্য মিথ্যা? এ আয়াতে কয়েকটি বিষয় প্রণিধানযোগ্য। প্রথমতঃ بِاَنْجُسِهِمْ শব্দ দ্বারা কুরআনুল করীম ইঙ্গিত করেছে যে, যে মুসলিম অন্য মুসলিমের দুর্নাম রটায় ও তাকে লাঞ্ছিত করে, সে প্রকৃতপক্ষে নিজেকেই লাঞ্ছিত করে। কারণ, ইসলামের সম্পর্ক সবাইকে এক করে দিয়েছে। সর্বক্ষেত্রে কুরআন এই ইঙ্গিত ব্যবহার করেছে। যেমন এক জায়গায় বলা হয়েছে وَلَاتَلْمِزُوْٓااَنْفُسَكُمْ [সূরা আল-হুজরাতঃ ১১] অর্থাৎ তোমাদের নিজেদের প্রতি দোষারোপ করো না। উদ্দেশ্য, কোন মুসলিম পুরুষ ও নারীর প্রতি দোষারোপ করো না। এ আয়াতে দ্বিতীয় প্রণিধানযোগ্য বিষয় এই যে, এখানে ظَنَّ الْمُؤُمِنُوْنَ বলা হয়েছে। এতে হাল্কা ইঙ্গিত রয়েছে যে, যাদের দ্বারা এই কাজ সংঘটিত হয়েছে, তারা এই কাজের প্রেক্ষাপটে মুমিন কথিত হওয়ার যোগ্য নয়। কেননা, এক মুসলিম অন্য মুসলিমের প্রতি সুধারণা পোষণ করবে এটাই ছিল ঈমানের দাবী। এখানে তৃতীয় প্রণিধানযোগ্য বিষয় হলো, এই আয়াতের শেষ বাক্য هٰذَٓااِفْكٌ مُّبِيْنٌ এ শিক্ষা দেয়া হয়েছে যে, খবরটি শুনামাত্রই মুসলিমদের ‘এটা প্ৰকাশ্য অপবাদ’ বলে দেয়াই ছিল ঈমানের দাবী। অর্থাৎ তাদের এ সব অপবাদ তো বিবেচনার যোগ্যই ছিল না। একথা শোনার সাথে সাথেই প্রত্যেক মুসলিমের একে সুস্পষ্ট মিথ্যাচার, মিথ্যা বানোয়াট কথা ও অপবাদ আখ্যা দেয়া উচিত ছিল। [বাগভী]
____________________
[১] এ আয়াতের প্রথম বাক্যে শিক্ষা আছে যে, এরূপ খবর রটনাকারীদের কথা চালু করার পরিবর্তে মুসলিমদের উচিত ছিল তাদের কাছে প্রমাণ দাবী করা। ব্যভিচারের অপরাধ সম্পর্কে শরীয়তসম্মত প্রমাণ চার জন সাক্ষী ছাড়া প্রতিষ্ঠিত হয় না। তাই তাদের কাছে এরূপ দাবী করা উচিত যে, তোমরা তোমাদের বক্তব্যের সপক্ষে চার জন সাক্ষী উপস্থিত কর, নতুবা মুখ বন্ধ কর। কারণ, তাদের দাবীর সপক্ষে কোন দলীল-প্রমাণ নেই। সামান্য সন্দেহ করাও সেখানে গৰ্হিত। দ্বিতীয় বাক্যে বলা হয়েছে, যখন তারা সাক্ষী উপস্থিত করতে পারল না, তখন আল্লাহ্র কাছে তারাই মিথ্যাবাদী। এখানে “আল্লাহ্র কাছে” অর্থাৎ আল্লাহ্র আইনে অথবা আল্লাহ্র আইন অনুযায়ী। নয়তো আল্লাহ্ তো জানতেন ঐ অপবাদ ছিল মিথ্যা। তারা সাক্ষী আনেনি বলেই তা মিথ্যা, আল্লাহ্র কাছে তার মিথ্যা হবার জন্য এর প্রয়োজন নেই। [দেখুন-বাগভী, ফাতহুল কাদীর]
____________________
[১] যেসব মুসলিম ভুলক্রমে এই অপবাদে কোন না কোনরূপে অংশগ্রহণ করেছিল, এরপর তাওবাহ করেছিল এবং কেউ কেউ শাস্তিও ভোগ করেছিল, এই আয়াত তাদের সম্পর্কে নাযিল হয়েছে। এ আয়াতে তাদের সবাইকে একথাও বলা হয়েছে যে, তোমাদের অপরাধ খুবই গুরুতর। এর কারণে দুনিয়াতেও আযাব আসতে পারত, যেমন পূর্ববর্তী জাতিসমূহের উপর এসেছে এবং আখেরাতেও কঠোর শাস্তি হত। কিন্তু মুসলিমদের সাথে আল্লাহ্ তা‘আলার আচরণ দয়া ও অনুগ্রহ মূলতঃ দুনিয়াতেও এবং আখেরাতেও। তাই এই শাস্তি তোমাদের উপর থেকে অন্তর্হিত হয়েছে। দুনিয়াতে আল্লাহ্র অনুগ্রহ ও রহমত এভাবে প্রকাশ পেয়েছে যে, প্রথমে তিনি ইসলাম ও ঈমানের তাওফীক দিয়েছেন, এরপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লামের সংসৰ্গ দান করেছেন। এটা আযাব নাযিলের পক্ষে প্রতিবন্ধক। এরপর কৃত গোনাহর জন্য সত্যিকার তাওবার তাওফীক দিয়েছেন এবং তাওবাহ কবুল করেছেন। আখেরাতে আল্লাহ্র অনুগ্রহ ও দয়ার প্রভাবে তোমাদেরকে ক্ষমা, মার্জনা ও মাগফেরাতের ওয়াদা দিয়েছেন। [দেখুন-মুয়াসসার, বাগভী]
____________________
[১] تلقى শব্দের মর্ম এই যে, একে অন্যের কাছে জিজ্ঞাসা ও বর্ণনা করে। এখানে কোন কথা শুনে তার সত্যাসত্য যাচাই না করে সামনে চালু করে দেয়া বুঝানো হয়েছে। অপর قراءة এ পড়া হয় تَلِقُّوْنَهُ তখন এর অর্থ হবে মিথ্যা বানিয়ে বলা। আয়েশা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা এভাবে পড়তেন। [বুখারীঃ ৪১৪৪]
[২] অর্থাৎ তোমরা একে তুচ্ছ ব্যাপার মনে করেছিলে যে, যা শুনলে তাই অন্যের কাছে বলতে শুরু করেছিলে। তোমরা সত্যাসত্য যাচাই না করে এমন কথা চালু করে দিয়েছিলে, যদ্দরুন অন্য মুসলিম দারুণ মর্মাহত হয়, লাঞ্ছিত হয় এবং তার জীবন দুর্বিষহ হয়ে পড়ে। হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ ‘কোন কোন লোক আল্লাহ্র অসন্তুষ্টি হয় এমন কথা বলে, অথচ সে জানে না যে, এটা কতদূর গিয়ে গড়াবে (অর্থাৎ সে কোন গুরুত্বের সাথে বলেনি)। অথচ এর কারণে সে জাহান্নামের আসমান ও যমীনের দূরত্বের চেয়েও বেশী গভীরে পৌছবে।’ [বুখারীঃ ৬৪৭৮, মুসলিমঃ ২৯৮৮]
____________________
[১] এখানে আল্লাহ্ তা‘আলা মুমিনদেরকে যে কোন খারাপ সংবাদ, অপবাদ তাদের কাছে বর্ণনা করা হলে তার সাথে কি আচরণ করতে হবে সে উত্তম চরিত্রের শিক্ষা দিয়েছেন। তাদেরকে এ সমস্ত অপবাদ মুখে উচ্চারণ করা থেকে নিষেধ করেছেন। কেননা, মানুষের প্রতিটি কথারই হিসাব দিতে হবে। পক্ষান্তরে যদি কোন কিছু মনে উদ্রেক হয় কিন্তু মুখে উচ্চারণ না করে, তবে তাতে গোনাহ লেখা হয় না। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ ‘আল্লাহ্ তা‘আলা আমার উম্মতের মনে যা উদিত হয় তা যতক্ষণ পর্যন্ত মুখে না বলে ততক্ষণের জন্য তা ক্ষমা করে দিয়েছেন।’ [বুখারীঃ ৫২৬৯, মুসলিমঃ ১২৭]
____________________
[১] এখানেও ১০ নং আয়াতের মতো উত্তর উহ্য রাখা হয়েছে। [বাগভী]
____________________
[১] আয়েশা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহার প্রতি অপবাদের ঘটনায় মুসলিমদের মধ্যে মিসতাহ্ ও হাস্সান জড়িয়ে পড়েছিলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম আয়াত নাযিল হওয়ার পর তাদের প্রতি অপবাদের শাস্তি প্রয়োগ করেন। তারা উভয়েই বিশিষ্ট সাহাবী এবং বদর-যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী বিশিষ্ট সাহাবীদের অন্যতম ছিলেন। কিন্তু তাদের দ্বারা একটি ভুল হয়ে যায় এবং তারা খাঁটি তাওবাহর তাওফীক লাভ করেন। আল্লাহ্ তা‘আলা যেমন আয়েশার দোষমুক্ততা প্রকাশ্যে আয়াত নাযিল করেন, এমনিভাবে এই মুসলিমদের তাওবাহ কবুল করা ও ক্ষমা করার কথাও ঘোষণা করে দেন।
মিসতাহ আবু বকর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুর আত্মীয় ও নিঃস্ব ছিলেন। আবু বকর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু তাকে আর্থিক সাহায্য করতেন। যখন অপবাদের ঘটনার সাথে তার জড়িত থাকার কথা প্রমাণিত হল, তখন কন্যা-বৎসল পিতা আবু বকর সিদ্দীক কন্যাকে এমন কষ্টদানের কারণে স্বাভাবিকভাবেই মিসতাহর প্রতি ভীষণ অসন্তুষ্ট হলেন। তিনি কসম করে বসলেন, ভবিষ্যতে তাকে কোনরূপ আর্থিক সাহায্য করবেন না। বলাবাহুল্য, কোন বিশেষ ফকীরকে আর্থিক সাহায্য নির্দিষ্টভাবে কোন বিশেষ মুসলিমের উপর ওয়াজিব নয়। কেউ কাউকে আর্থিক সাহায্য করার পর যদি বন্ধ করে দেয়, তবে গোনাহর কোন কারণ নেই। কিন্তু সাহাবায়ে কেরামের দলকে আল্লাহ্ তা‘আলা বিশ্বের জন্য একটি আদর্শ দলরূপে গঠন করতে ইচ্ছুক ছিলেন। তাই একদিকে বিচ্যুতিকারীদেরকে খাঁটি তাওবাহ এবং ভবিষ্যত সংশোধনের নেয়ামত দ্বারা ভূষিত করেছেন এবং অপরদিকে যারা স্বাভাবিক মনোকষ্টের কারণে গরীবদের সাহায্য ত্যাগ করার কসম করেছিলেন, তাদেরকেও আদর্শ চরিত্রের শিক্ষা আলোচ্য আয়াতে দান করেছেন। তাদেরকে বলা হয়েছে, তারা যেন কসম ভঙ্গ করে কাফফারা দিয়ে দেয়। গরীবদের আর্থিক সাহায্য থেকে হাত গুটিয়ে নেয়া তাদের উচ্চমর্যাদার পক্ষে সমীচীন নয়। আল্লাহ্ তা‘আলা যেমন তাদেরকে ক্ষমা করে দিয়েছেন, তেমনি তাদেরও ক্ষমা ও মার্জনা প্রদর্শন করা উচিত। [দেখুন-কুরতুবী]
[২] আয়াতের শেষ বাক্যে বলা হয়েছেঃ তোমরা কি পছন্দ করা না যে, আল্লাহ্ তা‘আলা তোমাদের গোনাহ মাফ করবেন? আয়াত শুনে আবু বকর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু তৎক্ষণাৎ বলে উঠলেনঃ
بَلىٰ وَاللّٰهِ يَا رَبَّنَا إنَّا لَنُحِبُّ أَنْ تَعْفِرَلَنَا
অর্থাৎ আল্লাহ্র কসম! আল্লাহ্ আমাকে মাফ করুন, আমি অবশ্যই তা পছন্দ করি। এরপর তিনি মিসতাহর আর্থিক সাহায্য পুনর্বহাল করে দেন এবং বলেনঃ এ সাহায্য কোনদিন বন্ধ হবে না। [বুখারীঃ ৪৭৫৭, মুসলিমঃ ২৭৭০]
____________________
[১] মূলে (গাফেলাত) শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। এর অর্থ হচ্ছে, সরলমনা ও ভদ্র মহিলারা, যারা ছল-চাতুরী জানে না, যাদের মন নিৰ্মল, কলুষমুক্ত ও পাক-পবিত্র, যারা অসভ্যতা ও অশ্ৰীল আচরণ কি ও কিভাবে করতে হয় তা জানে না এবং কেউ তাদের বিরুদ্ধে অপবাদ দেবে একথা যারা কোনদিন কল্পনাও করতে পারে না। হাদীসে বলা হয়েছে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, নিষ্কলুষ মহিলাদের বিরুদ্ধে অপবাদ দেয়া সাতটি “সর্বনাশা” কবীরাহ গোনাহের অন্তরভুক্ত। [দেখুন, বুখারীঃ ২৭৬৬, মুসলিমঃ ৮৯]
[২] আয়েশা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহার এমন কতিপয় বৈশিষ্ট্য আছে, যেগুলো অন্য কোন মহিলার ভাগ্যে জোটেনি। তিনি নিজেও আল্লাহ্র নেয়ামত প্ৰকাশার্থে এসব বিষয় গর্বভরে বর্ণনা করতেন।
প্রথম- হাদীসে এসেছে, আয়েশা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা বলেনঃ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে বিয়ে হওয়ার পূর্বে ফিরিশতা জিবরাঈল ‘আলাইহিস সালাম একটি রেশমী কাপড়ে আমার ছবি নিয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট আগমন করেন এবং বলেনঃ এ আপনার স্ত্রী। [তিরমিযীঃ ৩৮৮০]
দ্বিতীয়- রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে ছাড়া কোন কুমারী বালিকাকে বিয়ে করেননি।
তৃতীয়- তার কোলে মাথা রেখে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইন্তেকাল করেন।
চতুৰ্থ- আয়েশা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহার গৃহেই তিনি সমাধিস্থ হন।
পঞ্চম- রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট তখনো ওহী নাযিল হত, যখন তিনি আয়েশার সাথে একই লেপের নীচে শায়িত থাকতেন। অন্য কোন স্ত্রীর এরূপ বৈশিষ্ট্য ছিল না। [তিরমিযীঃ ৩৮৭৯]
ষষ্ট- আসমান থেকে তার নির্দোষিতার বিষয় নাযিল হয়েছে।
সপ্তম- তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের খলীফার কন্যা এবং সিদ্দীকা ছিলেন। আল্লাহ্ তা‘আলা যাদেরকে দুনিয়াতেই ক্ষমা ও সম্মানজনক জীবিকার ওয়াদা দিয়েছেন, তিনি তাদেরও অন্যতমা।
অষ্টম- সাহাবাগণ কোন ব্যাপারে সমস্যায় পড়ে আয়েশা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহার কাছে আসলে তার কাছে কোন না কোন ইলম পেতেন।
আয়েশা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহার ফকীহ ও পণ্ডিতসুলভ জ্ঞানানুসন্ধান এবং বিজ্ঞজনোচিত বক্তব্য দেখে মূসা ইবনে তালহা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেনঃ আমি আয়েশা সিদ্দীকা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহার চাইতে অধিক শুদ্ধভাষী ও প্রাঞ্জলভাষী কাউকে দেখিনি। [তিরমিযীঃ ৩৮৮৪] কোন কোন মুফাসসির বলেনঃ ইউসুফ ‘আলাইহিস সালামের প্রতি অপবাদ আরোপ করা হলে আল্লাহ্ তা‘আলা একটি কচি শিশুকে বাকশক্তি দান করে ওর সাক্ষ্য দ্বারা তার দোষমুক্ততা প্রকাশ করেন। মারইয়ামের প্রতি অপবাদ আরোপ করা হলে আল্লাহ্ তা‘আলা তার শিশু পুত্ৰ ঈসা ‘আলাইহিস সালামের সাক্ষ্য দ্বারা তাকে দোষমুক্ত করেন। আয়েশা সিদ্দীকা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহার প্রতি অপবাদ আরোপ করা হলে আল্লাহ্ তা‘আলা কুরআনের দশটি আয়াত নাযিল করে তার দোষমুক্ততা ঘোষণা করেন, যা তার গুণ ও জ্ঞান-গরিমাকে আরো বাড়িয়ে দিয়েছে।
____________________
[১] অর্থাৎ যেদিন তাদের বিরুদ্ধে স্বয়ং তাদের জিহ্বা ও হস্তপদাদী কথা বলবে ও তাদের অপরাধসমূহের সাক্ষ্য দেবে। হাদীসে এসেছে, কেয়ামতের দিন যে গোনাহগার তার গোনাহর স্বীকার করবে, আল্লাহ্ তা‘আলা তাকে মাফ করে দেবেন এবং হাশরের মাঠে সবার দৃষ্টি থেকে তার গোনাহ গোপন রাখবেন। [দেখুন- বুখারীঃ ৬০৭০, মুসলিমঃ ২৭৬৮, মুসনাদে আহমাদঃ ২/৭৪] পক্ষান্তরে যে ব্যাক্তি সেখানেও অস্বীকার করে বলবে যে, আমি এ কাজ করিনি; পরিদর্শক ফিরিশতারা ভুল করে এটা আমার আমলনামায় লিখে দিয়েছে, তখন তার মুখ বন্ধ করে দেয়া হবে এবং হস্তপদের সাক্ষ্য গ্ৰহণ করা হবে। তখন তারা বলবে এবং সাক্ষ্য দেবে। [দেখুন- মুসলিমঃ ২৯৬৮, ২৯৬৯]
____________________
[১] অর্থাৎ দুশ্চরিত্রা নারীকুল দুশ্চরিত্র পুরুষকুলের জন্য এবং দুশ্চরিত্র পুরুষকুল দুশ্চরিত্রা নারীকুলের জন্য উপযুক্ত। সচ্চরিত্রা নারীকুল সচ্চরিত্র পুরুষকুলের জন্য এবং সচ্চরিত্র পুরুষকুল সচ্চরিত্রা নারীকুলের জন্য উপযুক্ত। এদের সম্পর্কে লোকে যা বলে, এরা তা থেকে পবিত্র। এদের জন্য রয়েছে ক্ষমা ও সম্মানজনক জীবিকা। এ আয়াতে একটি নীতিগত কথা বুঝানো হয়েছে। আল্লাহ্ তা‘আলা মানবচরিত্রে স্বাভাবিকভাবে যোগসূত্র রেখেছেন। দুশ্চরিত্রা, ব্যভিচারিণী নারী ব্যভিচারী পুরুষের প্রতি এবং দুশ্চরিত্র ও ব্যভিচারী পুরুষ দুশ্চরিত্রা নারীদের প্রতি আকৃষ্ট হয়। এমনিভাবে সচ্চরিত্রা নারীদের আগ্রহ সচ্চরিত্র পুরুষদের প্রতি এবং সচ্চরিত্র পুরুষদের আগ্রহ সচ্চরিত্রা নারীদের প্রতি হয়ে থাকে। প্রত্যেকেই নিজ নিজ আগ্রহ অনুযায়ী জীবনসঙ্গী খোঁজ করে নেয় এবং আল্লাহ্র বিধান অনুযায়ী সে সেরূপই পায়।
কোন কোন মুফাসসির এ আয়াতের এ অর্থও করেছেন যে, খারাপ কথা খারাপ লোকদের জন্য (অর্থাৎ তারা এর হকদার) এবং ভালো কথা ভালো লোকদের জন্য, আর ভালো লোকদের সম্পর্কে দুর্মুখেরা যেসব কথা বলে তা তাদের প্রতি প্ৰযুক্ত হওয়া থেকে তারা মুক্ত ও পবিত্র। অন্য কিছু মুফাসসির এর অর্থ করেছেন এভাবে, খারাপ কাজ খারাপ লোকদের পক্ষেই সাজে এবং ভালো কাজ ভালো লোকদের জন্যই শোভনীয়, ভালো লোকেরা খারাপ কাজের অপবাদ বহন থেকে পবিত্র। ভিন্ন কিছু তাফসীরকারক এর অর্থ নিয়েছেন এভাবে, খারাপ কথা খারাপ লোকদেরই বলার মতো এবং ভালো লোকেরা ভালো কথাই বলে থাকে, অপবাদদাতারা যে ধরনের কথা বলছে ভালো লোকেরা তেমনি ধরনের কথা বলা থেকে পবিত্র। [দেখুন-ইবন কাসীর, সা‘দী, কুরতুবী, বাগভী]
____________________
[১] এ আয়াতে অন্য কারো গৃহে প্রবেশের পূর্বে অনুমতি নেয়ার বিধান আলোকপাত করা হয়েছে। অন্য কারো গৃহে প্রবেশের পূর্বে অনুমতি নেয়ার বিধানে প্রতিটি ইমানদার নারী, পুরুষ, মাহরাম ও গায়র-মাহরাম সবাই শামিল রয়েছে। আতা ইবন আবী রাবাহ বৰ্ণনা করেন যে, আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা বলেনঃ অনুমতি নেয়া মানুষ অস্বীকার করছে, বর্ণনাকারী বলল, আমি বললামঃ আমার কিছু ইয়াতীম বোন রয়েছে, তারা আমার কাছে আমার ঘরেই প্রতিপালিত হয়, আমি কি তাদের কাছে যাবার সময় অনুমতি নেব? তিনি বললেনঃ হ্যাঁ। আমি কয়েকবার তার কাছে সেটা উত্থাপন করে এ ব্যাপারে ব্যতিক্রম করার অনুরোধ করলাম। কিন্তু তিনি অস্বীকার করলেন। এবং বললেনঃ তুমি কি তাদেরকে উলঙ্গ দেখতে চাও? [বুখারীঃ আদাবুল মুফরাদ- ১০৬৩] ইমাম মালেক মুয়াত্তা গ্রন্থে আতা ইবনে ইয়াসার থেকে বর্ণনা করেন যে, জনৈক ব্যাক্তি রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞাসা করলঃ আমি আমার মায়ের কাছে যাওয়ার সময়ও অনুমতি চাইব? তিনি বললেনঃ হ্যাঁ, অনুমতি চাও। তিনি বললেনঃ হে আল্লাহ্র রাসূল, আমি তো আমার মায়ের ঘরেই বসবাস করি। তিনি বললেনঃ তবুও অনুমতি না নিয়ে ঘরে যাবে না। লোকটি আবার বললঃ হে আল্লাহ্র রাসূল, আমি তো সর্বদা তার কাছেই থাকি। তিনি বললেনঃ তবুও অনুমতি না নিয়ে ঘরে যাবে না। তুমি কি তোমার মাকে উলঙ্গ অবস্থায় দেখা পছন্দ কর? সে বললঃ না। তিনি বললেনঃ তাই অনুমতি চাওয়া আবশ্যক । [মুয়াত্তা ইমাম মালেকঃ ১৭২৯]
[২] আয়াতে
حَتَّىٰ تَسْتَأْنِسُوا وَتُسَلِّمُوا عَلَىٰ أَهْلِهَا
বলা হয়েছে; অর্থাৎ দু’টি কাজ না করা পর্যন্ত কারো গৃহে প্রবেশ করো না।
প্রথম বলা হয়েছে, تَسْتَأنِسُوا বিশিষ্ট তাফসীরকারগণের মতে এর অর্থ, تَسْتَأْذِنُوا বা অনুমতি হাসিল করা। কিন্তু আসলে উভয় ক্ষেত্রে শাব্দিক অর্থের মধ্যে সূক্ষ্ম পার্থক্য আছে। تَسْتَأْذِنُوا বললে আয়াতের অর্থ হতোঃ “কারোর বাড়িতে প্ৰবেশ করো না যতক্ষণ না অনুমতি নিয়ে নাও।” এ প্রকাশ ভংগী পরিহার করে আল্লাহ্ تَسْتَأنِسُوا শব্দ ব্যবহার করেছেন। যার অর্থ হয়, পরিচিতি, অন্তরংগতা, সম্মতি ও প্রীতি সৃষ্টি করা। আর এটা যখনই বলা হবে তখনই এর মানে হবে, সম্মতি আছে কি না জানা অথবা নিজের সাথে অন্তরংগ করা, সম্প্রীতি তৈরী করা। কাজেই আয়াতের সঠিক অর্থ হবেঃ ‘‘লোকদের গৃহে প্রবেশ করো না, যতক্ষণ না তাদেরকে অন্তরংগ করে নেবে অথবা তাদের সম্মতি জেনে নেবে।” অর্থাৎ একথা না জেনে নেবে যে, গৃহমালিক তোমার আসাকে অপ্রীতিকর বা বিরক্তিকর মনে করছে না এবং তার গৃহে তোমার প্রবেশকে সে পছন্দ করছে। এখানে استِيناٰسْ শব্দ উল্লেখ করার মধ্যে ইঙ্গিত আছে যে, প্রবেশের পূর্বে অনুমতি লাভ করার দ্বারা প্রতিপক্ষ পরিচিত ও আপন হয়, ফলে সে আতঙ্কিত হয় না। [দেখুন-বাগভী, সা‘দী, আইসারুত তাফসির]
দ্বিতীয় কাজ এই যে, গৃহের লোকদেরকে সালাম কর। কোন কোন মুফাসসির এর অর্থ নিয়েছেন যে, প্রথমে অনুমতি লাভ কর এবং গৃহে প্রবেশের সময় সালাম কর। কুরতুবী এই অর্থই পছন্দ করেছেন। এই অর্থের দিক দিয়ে আয়াতে অগ্র-পশ্চাত নেই। কোন কোন আলেম বলেনঃ যদি অনুমতি নেয়ার পূর্বে গৃহের কোন ব্যাক্তির উপর দৃষ্টি পড়ে, তবে প্রথমে সালাম করবে, এরপর অনুমতি চাইবে। নতুবা প্রথমে অনুমতি নেবে এবং গৃহে প্রবেশ করার সময় সালাম করবে। [দেখুন- বাগভী] কিন্তু অধিকাংশ হাদীস থেকে সুন্নত তরীকা এটাই জানা যায় যে, প্রথমে বাইরে থেকে সালাম করবে, এরপর নিজের নাম নিয়ে বলবে যে, অমুক ব্যাক্তি সাক্ষাত করতে চায়। বিভিন্ন হাদীসগুলো থেকে প্রথমে সালাম ও পরে প্রবেশের অনুমতি গ্রহণের বিষয় প্রমাণিত হয়েছে। এতে নিজের নাম উল্লেখ করে অনুমতি চাওয়াই উত্তম। হাদীসে আছে, আবু মূসা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু উমর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুর কাছে গেলেন এবং অনুমতি চাওয়ার জন্য বললেন,
السَّلامُ عَليْكُم هٰذا عَبْدُ اللّٰه بن قَيْس، السَّلامُ عَليْكُم هَذاأَبو مُو سَى، السَّلامُ عَليْكُم هَذاالأَشْعري
[মুসলিমঃ ২১৫৪] এতেও তিনি প্রথমে নিজের নাম আবু মূসা বলেছেন, এরপর আরো নির্দিষ্টভাবে প্রকাশ করার জন্য আল-আশ‘আরী বলেছেন ।
[৩] এ হুকুমটি নাযিল হবার পর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যেসব নিয়ম ও রীতিনীতির প্রচলন করেন নীচে সেগুলোর কিছু বর্ণনা করা হলোঃ
একঃ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ব্যাক্তিগত গোপনীয়তার এ অধিকারটিকে কেবলমাত্র গৃহের চৌহদ্দীর মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখেননি। বরং একে একটি সাধারণ অধিকার গণ্য করেন। এ প্রেক্ষিতে অন্যের গৃহে উঁকি ঝুঁকি মারা, বাহির থেকে চেয়ে দেখা নিষিদ্ধ। এক ব্যক্তি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে এলেন এবং ঠিক তার দরজার উপর দাঁড়িয়ে অনুমতি চাইলেন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে বললেন, “পিছনে সরে গিয়ে দাঁড়াও, যাতে দৃষ্টি না পড়ে। সে জন্যই তো অনুমতি চাওয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে।” [আবু দাউদঃ ৫১৭৪] নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিজের নিয়ম ছিল এই যে, যখন কারোর বাড়িতে যেতেন, দরজার ঠিক সামনে কখনো দাঁড়াতেন না। তিনি দরজার ডান পাশে বা বাম পাশে দাঁড়িয়ে অনুমতি চাইতেন। [আবু দাউদঃ ৫১৮৬] রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের খাদেম আনাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন, এক ব্যাক্তি বাইরে থেকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কামরার মধ্যে উঁকি দিলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাতে সে সময় একটি তীর ছিল। তিনি তার দিকে এভাবে এগিয়ে এলেন যেন তীরটি তার পেটে ঢুকিয়ে দেবেন। [আবু দাউদঃ ৫১৭১] অপর বর্ণনায় এসেছে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ “যদি কোন ব্যাক্তি তোমার গৃহে উঁকি মারে এবং তুমি একটি কাঁকর মেরে তার চোখ কানা করে দাও, তাহলে তাতে কোন গোনাহ হবে না।” [মুসলিমঃ ২১৫৮, মুসনাদে আহমাদঃ ২/২২৩, ২/৪২৮] অন্য হাদীসে বলা হয়েছেঃ “যে ব্যাক্তি কারোর ঘরে উঁকি মারে এবং ঘরের লোকেরা তার চোখ ছেঁদা করে দেয়, তবে তাদের কোন জবাবদিহি করতে হবে না।’’ [আবু দাউদঃ ৫১৭২]
দুইঃ কেবলমাত্র অন্যের গৃহে প্রবেশ করার অনুমতি নেবার হুকুম দেয়া হয়নি বরং নিজের মা-বোনদের কাছে যাবার সময়ও অনুমতি নিতে হবে। আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেনঃ “নিজের মা-বোনদের কাছে যাবার সময়ও অনুমতি নিয়ে যাও।’’ [ইবনে কাসীর]
তিনঃ প্রথম যখন অনুমতি চাওয়ার বিধান জারি হয় তখন লোকেরা তার নিয়ম কানুন জানতো না। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদেরকে এ ব্যাপারে বিস্তারিত শিক্ষা দেন। যেমন, তাদেরকে ঘরে ঢুকার অনুমতির জন্য সঠিক শব্দ নির্বাচন করা শিখিয়ে দেনঃ একবার এক ব্যাক্তি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে আসে এবং দরজা থেকে চিৎকার করে বলতে থাকে “আমি কি ভেতরে ঢুকে যাবো?” নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার খাদেমকে বললেনঃ এ ব্যাক্তি অনুমতি চাওয়ার নিয়ম জানে না। একটু উঠে গিয়ে তাকে বলে এসো, “আসসালামু আলাইকুম, আমি কি ভিতরে আসতে পারি?” বলতে হবে। [আবু দাউদঃ ৫১৭৭]।
তাদেরকে নিজের পরিচয় স্পষ্টভাবে দেয়ার জন্য নির্দেশ দেনঃ জাবের ইবনে আবদুল্লাহ বলেন, আমি আমার বাবার ঋণের ব্যাপারে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে গেলাম এবং দরজায় করাঘাত করলাম। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, কে? আমি বললাম, আমি। তিনি দু-তিনবার বললেন, “আমি? আমি?” অর্থাৎ এখানে আমি বললে কে কি বুঝবে যে, তুমি কে? [বুখারীঃ ৬২৫০, মুসলিমঃ ২১৫৫, আবু দাউদঃ ৫১৮৭] এতে বুঝা গেল যে, অনুমতি চাওয়ার সঠিক পদ্ধতি ছিল, মানুষ নিজের নাম বলে অনুমতি চাইবে। উমর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু অনুমতি নেয়ার ক্ষেত্রে বলতেনঃ “আসসালামু আলাইকুম, হে আল্লাহ্র রসূল! উমর কি ভেতরে যাবে?” [আবু দাউদঃ ৫২০১]
সালাম ব্যতীত কেউ ঢুকে গেলে তাকে ফেরত দিয়ে সালামের মাধ্যমে ঢুকা শিখিয়ে দিলেনঃ এক ব্যাক্তি কোন কাজে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে গেলেন। সালাম ছাড়াই এমনিই সেখানে গিয়ে বসলেন। তিনি বললেন, বাইরে যাও এবং আসসালামু আলাইকুম বলে ভেতরে এসো। [আবু দাউদঃ ৫১৭৬]
অনুমতি লাভের জন্য সালাম দেয়াঃ অনুমতি নেবার জন্য নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বড় জোর তিনবার ডাক দেবার সীমা নির্দেশ করেছেন এবং বলেছেন যদি তিনবার ডাক দেবার পরও জবাব না পাওয়া যায়, তাহলে ফিরে যাও। আবু মূসা রাদিয়াল্লাহু আনহু একবার উমর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুর কাছে আসলেন এবং তিনবার সালাম দিলেন। কিন্তু উমর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু কোন উত্তর না করায় তিনি ফিরে চললেন। তখন লোকেরা বললঃ আবু মূসা ফিরে যাচ্ছে। উমর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বললেনঃ তাকে ফিরিয়ে আন, তাকে ফিরিয়ে আন। ফিরে আসার পর উমর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু তাকে জিজ্ঞেস করলেনঃ তুমি ফিরে যাচ্ছিলে কেন? আমরা কাজে ব্যস্ত ছিলাম। আবু মূসা বললেনঃ আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি যে, ‘অনুমতি তিন বার, যদি তাতে অনুমতি দেয় ভাল, নতুবা ফিরে যাও।’ [বুখারীঃ ৬২৪৫, মুসলিমঃ ২১৫৪] নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজেও এ পদ্ধতি অনুসরণ করতেন। একবার তিনি সা‘দ ইবনে উবাদার বাড়ীতে গেলেন এবং আসসালামু আলাইকুম ওয়া রহমাতুল্লাহ বলে দু’বার অনুমতি চাইলেন। কিন্তু ভেতর থেকে জবাব এলো না। তৃতীয় বার জবাব না পেয়ে ফিরে গেলেন। সা‘দ ভেতর থেকে দৌড়ে এলেন এবং বললেনঃ হে আল্লাহ্র রসূল! আমি আপনার আওয়াজ শুনছিলাম। কিন্তু আমার মন চাচ্ছিল আপনার মুবারক কণ্ঠ থেকে আমার জন্য যতবার সালাম ও রহমতের দো‘আ বের হয় ততই ভালো, তাই আমি খুব নীচু স্বরে জবাব দিচ্ছিলাম। [আবু দাউদঃ ৫১৮৫ ও আহমাদঃ ৩/১৩৮]
চারঃ অনুরূপভাবে কেউ যদি সফর হতে ফিরে আসে তবে আপন স্ত্রীর কাছে যাবার আগেও অনুমতি নিয়ে যাওয়া সুন্নত। যাতে তাকে অপ্ৰস্তুত অবস্থায় না পায়। এ ব্যাপারে বিভিন্ন হাদীস এসেছে। [দেখুন- বুখারীঃ ৫০৭৯, মুসলিমঃ ৭১৫]
____________________
[১] অর্থাৎ কারোর শূন্য গৃহে প্রবেশ করা জায়েয নয়। তবে যদি গৃহকর্তা নিজেই প্রবেশকারীকে তার খালি ঘরে প্রবেশ করার অনুমতি দিয়ে থাকে, তাহলে প্রবেশ করতে পারে। [ফাতহুল কাদীর]
[২] অর্থাৎ যদি আপাততঃ ফিরে যেতে বলা হয়, তখন হৃষ্টচিত্তে ফিরে আসা উচিত। একে খারাপ মনে করা অথবা সেখানেই অটল হয়ে বসে থাকা উভয়ই অসঙ্গত। [দেখুন- বাগভী, মুয়াসসার]
____________________
[১] আয়াতে بْيُوْتًاغَيْرَمَسْكُوْنَةٍ বলে এমন গৃহ বুঝানো হয়েছে, যা কোন বিশেষ ব্যাক্তি অথবা গোষ্ঠীর বাসগৃহ নয়; বরং সেটাকে ভোগ করার ও সেখানে অবস্থান করার অধিকার প্রত্যেকের আছে। যেমন বিভিন্ন শহরে ও প্রান্তরে এই উদ্দেশ্যে নির্মিত মুসাফিরখানাসমূহ, হোটেল, বাজার এবং একই কারণে মসজিদ, দ্বীনী পাঠাগার ইত্যাদি সব জনহিতকর প্রতিষ্ঠানও এই বিধানের অন্তর্ভুক্ত। যেখানে লোকদের জন্য প্রবেশের সাধারণ অনুমতি আছে এসব স্থানে প্রত্যেকেই বিনা অনুমতিতে প্রবেশ করতে পারে। [তাবারী, ফাতহুল কাদীর, মুয়াসসার]
[২] مَتَاعٌ শব্দের আভিধানিক অর্থ কোন বস্তুকে ভোগ করা, ব্যবহার করা এবং তা দ্বারা উপকৃত হওয়া। যার দ্বারা উপকৃত হওয়া যায় তাকেও مَتَاعٌ বলা হয়। [কুরতুবী, বাগভী]
____________________
[১] যৌনাঙ্গ সংযত রাখার অর্থ অত্যন্ত ব্যাপক। নিম্নে তার কিছু উদাহরণ পেশ করা হলোঃ
কুপ্রবৃত্তি চরিতাৰ্থ করার যত পন্থা আছে, সবগুলো থেকে যৌনাঙ্গকে সংযত রাখা। এতে ব্যভিচার, পুংমৈথুন, দুই নারীর পারস্পরিক ঘর্ষণ- যাতে কামভাব পূর্ণ হয় এবং হস্তমৈথুন ইত্যাদি সব অবৈধ কৰ্ম অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। [দেখুন-সা‘দী, ফাতহুল কাদীর] আয়াতের উদ্দেশ্য অবৈধ ও হারাম পন্থায় কাম প্রবৃত্তি চরিতাৰ্থ করা এবং তার সমস্ত ভূমিকাকে নিষিদ্ধ করা। তন্মধ্যে কাম-প্রবৃত্তির প্রথম ও প্রারম্ভিক কারণ হচ্ছে- দৃষ্টিপাত করা ও দেখা এবং সর্বশেষ পরিণতি হচ্ছে ব্যভিচার। এ দু’টিকে স্পষ্টতঃ উল্লেখ করে হারাম করে দেয়া হয়েছে। এতদুভয়ের অন্তর্বর্তী হারাম ভূমিকাসমূহ- যেমন কথাবার্তা শোনা, স্পর্শ করা ইত্যাদি প্রসঙ্গক্রমে এগুলোর অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেছে। ইবনে সীরীন রাহিমাহুল্লাহ আবিদা আস-সালমানী রাহিমাহুল্লাহ থেকে বর্ণনা করেন যে, যা দ্বারা আল্লাহ্র বিধানের বিরুদ্ধাচরণ হয়, তাই কবীরা গোনাহ। কিন্তু আয়াতে তার দুই প্রান্ত- সূচনা ও পরিণতি উল্লেখ করা হয়েছে। সূচনা হচ্ছে চোখ তুলে দেখা এবং পরিণতি হচ্ছে ব্যভিচার। জারীর ইবন আব্দুল্লাহ বাজালী থেকে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ ‘ইচ্ছা ছাড়াই হঠাৎ কোন বেগানা নারীর উপর দৃষ্টি পতিত হলে সেদিক থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নাও। [মুসলিমঃ ২১৫৯] আলী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুর হাদীসে আছে, ‘প্রথম দৃষ্টি মাফ এবং দ্বিতীয় দৃষ্টিপাত গোনাহ।’ [আবু দাউদঃ ২১৪৯, তিরমিযীঃ ২৭৭৭, মুসনাদে আহমাদঃ ৫/৩৫১, ৩৫৭] এর উদ্দেশ্য এই যে, প্রথম দৃষ্টিপাত অকস্মাৎ ও অনিচ্ছাকৃত হওয়ার কারণে ক্ষমার্হ। নতুবা ইচ্ছাকৃতভাবে প্রথম দৃষ্টিপাতও ক্ষমার্হ নয়। হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ ‘আল্লাহ্ তা‘আলা বনী আদমের উপর কিছু কিছু ব্যভিচার (যিনা) হবে জানিয়ে দিয়েছেন, তা অবশ্যই সংঘটিত হবে। চক্ষুর যিনা হল তাকানো,....। [বুখারীঃ ৬২৪৩, ৬৬১২, মুসলিমঃ ২৬৫৭]
তদ্রুপ নিজের সতরকে অন্যের সামনে উন্মুক্ত করা থেকে দূরে থাকাও যৌনাঙ্গ সংযত করার পর্যায়ভুক্ত। [ফাতহুল কাদীর] পুরুষের জন্য সতর তথা লজ্জাস্থানের সীমানা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নাভী থেকে হাঁটু পর্যন্ত নির্ধারণ করেছেন। তিনি বলেছেনঃ “নাভী থেকে হাঁটু পর্যন্ত সতর।” [দারুকুতনীঃ ৯০২] শরীরের এ অংশ স্ত্রী ছাড়া আর কারোর সামনে ইচ্ছাকৃতভাবে খোলা হারাম। জারহাদে আল- আসলামী বৰ্ণনা করেছেন, একবার রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মজলিসে আমার রান খোলা অবস্থায় ছিল। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ “তুমি কি জানো না, রান ঢেকে রাখার জিনিস?” [তিরমিযীঃ ২৭৯৬, আবু দাউদঃ ৪০১৪] অন্য একটি হাদীসে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ “নিজের স্ত্রী ও ক্রীতদাসী ছাড়া বাকি সবার থেকে নিজের সতরের হেফাজত করো।” এক ব্যাক্তি জিজ্ঞেস করে, আর যখন আমরা একাকী থাকি? জবাব দেনঃ “এ অবস্থায় আল্লাহ্ থেকে লজ্জা করা উচিত, তিনিই এর হকদার।” [আবু দাউদঃ ৪০১৭, তিরমিযীঃ ২৭৬৯, ইবনে মাজাহঃ ১৯২০]। অন্য হাদীসে এসেছে, রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ ‘কোন লোক যেন অপর লোকের লজ্জাস্থানের দিকে না তাকায়, অনুরূপভাবে কোন মহিলা যেন অপর মহিলার লজ্জাস্থানের দিকে না তাকায় এবং কোন পুরুষ যেন অপর কোন পুরুষের সাথে একই কাপড়ে অবস্থান না করে, তদ্রুপ কোন মহিলাও যেন অপর মহিলার সাথে একই কাপড়ে অবস্থান না করে। [মুসলিমঃ ৩৩৮] অপর এক হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, তোমরা রাস্তায় বসা থেকে বেঁচে থাক। লোকেরা বললঃ আমরা এ ধরণের বসা থেকে বাঁচতে পারি না; কেননা, সেখানে বসে আমরা কথাবার্তা বলে থাকি। তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ যদি বসা ব্যতীত তোমার গত্যন্তর না থাকে তবে পথের হক আদায় করবে। তারা বললঃ পথের দাবী কি? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ চক্ষু নত করা, কষ্টদায়ক বিষয় দূর করা, সালামের জবাব দেয়া, সৎকাজের আদেশ করা, অসৎকাজ থেকে নিষেধ করা। [বুখারীঃ ২৪৬৫, মুসলিমঃ ২১২১]
অনুরূপভাবে দাড়ি-গোঁফ বিহীন বালকদের প্রতি ইচ্ছাকৃত দৃষ্টিপাত করাও অনুচিত। ইবনে কাসীর লিখেছেন- পূর্ববর্তী অনেক মনীষী শ্মশ্রুবিহীন বালকদের প্রতি অপলক নেত্ৰে তাকিয়ে থাকাকে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করেছেন এবং অনেক আলেমের মতে এটা হারাম।
____________________
[১] এ দীর্ঘ আয়াতের সূচনাভাগে সেই বিধানই বর্ণিত হয়েছে, যা পূর্ববর্তী আয়াতে পুরুষদের জন্য ব্যক্ত হয়েছে। অর্থাৎ তারা যেন দৃষ্টি নত রাখে তথা দৃষ্টি ফিরিয়ে নেয়। পুরুষদের বিধানে নারীরাও অন্তর্ভুক্ত ছিল, কিন্তু জোর দেয়ার জন্য তাদের কথা পৃথকভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। [কুরতুবী, ফাতহুল কাদীর] অনেক আলেমের মতেঃ নারীদের জন্য মাহরাম নয়, এমন পুরুষের প্রতি দেখা সর্বাবস্থায় হারাম; কামভাব সহকারে বদ নিয়তে দেখুক অথবা এ ছাড়াই দেখুক। [ইবন কাসীর] তার প্রমাণ উম্মে সালমা বর্ণিত হাদীস যাতে বলা হয়েছেঃ ‘একদিন উম্মে-সালমা ও মায়মুনা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা উভয়েই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে ছিলেন। হঠাৎ অন্ধ সাহাবী আব্দুল্লাহ ইবনে উম্মে মাকতুম তথায় আগমন করলেন। এই ঘটনার সময়-কাল ছিল পর্দার আয়াত নাযিল হওয়ার পর। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের উভয়কে পর্দা করতে আদেশ করলেন। উম্মে-সালমা বললেনঃ হে আল্লাহ্র রাসূল, সে তো অন্ধ, সে আমাদেরকে দেখতে পাবে না এবং আমাদেরকে চেনেও না। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ তোমরা তো অন্ধ নও, তোমরা তাকে দেখছ। [তিরমিযীঃ ২৭৭৮, আবু দাউদঃ ৪১১২] তবে হাদীসটির সনদ দূর্বল। অপর কয়েকজন ফেকাহবিদ বলেনঃ কামভাব ব্যতীত বেগানা পুরুষকে দেখা নারীর জন্য দোষনীয় নয়। তাদের প্রমাণ আয়েশা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহার হাদীস, যাতে বলা হয়েছেঃ একবার ঈদের দিন মসজিদে নববীর আঙ্গিনায় কিছু সংখ্যক হাবশী যুবক সামরিক কুচকাওয়াজ করছিল। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই কুচকাওয়াজ নিরিক্ষণ করতে থাকেন এবং তার আড়ালে দাঁড়িয়ে আয়েশা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহাও এই কুচকাওয়াজ উপভোগ করতে থাকেন এবং নিজে অতিষ্ঠ না হওয়া পর্যন্ত দেখে যান। [বুখারীঃ ৪৫৫, মুসলিমঃ ৭৯২]
[২] অর্থাৎ তারা যেন অবৈধ যৌন উপভোগ থেকে দূরে থাকে এবং নিজের সতর অন্যের সামনে উন্মুক্ত করাও পরিহার করে। [তাবারী, ইবন কাসীর] হাদীসে এসেছে, “মহিলা হলো আওরত তথা গোপণীয় বিষয়” [তিরমিযীঃ ১১৭৩, সহীহ ইবনে হিব্বানঃ ৫৫৯৯, সহীহ ইবনে খুযাইমাহঃ ১৬৮৫] পুরুষদের জন্য মেয়েদের সতর তার সারা শরীর। স্বামী ছাড়া অন্য কোন-পুরুষ এমন কি বাপ ও ভাইয়ের সামনেও তা খোলা উচিত নয়। মেয়েদের এমন পাতলা বা চোস্ত পোশাক পরা উচিত নয় যার মধ্য দিয়ে শরীর দেখা যায় বা শরীরের গঠন কাঠামো ভেতর থেকে ফুটে উঠতে থাকে। আয়েশা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা বৰ্ণনা করেন, তার বোন আসমা বিনতে আবু বকর রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সামনে আসেন। তখন তিনি পাতলা কাপড় পরে ছিলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সংগে সংগেই মুখ ফিরিয়ে নেন এবং বলেনঃ ‘‘হে আসমা! কোন মেয়ে যখন বালেগ হয়ে যায় তখন তার এটা ও ওটা ছাড়া শরীরের কোন অংশ দেখা যাওয়া জায়েয নয়।” বর্ণনাকারী বলেনঃ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার হাতের কব্জি ও চেহারার দিকে ইঙ্গিত করেছেন। [আবু দাউদঃ ৪১০৪]
[৩] আয়াতের অর্থ এই যে, মুহরিম ব্যতিত সাজ-সজ্জার স্থানসমূহ প্রকাশ না করা মহিলাদের উপর ওয়াজিব। [তাবারী, বাগভী]
[৪] আয়াতে পর্দার বিধানের কয়েকটি ব্যতিক্রম আলোচনা করা হচ্ছে। প্রথম ব্যতিক্রম হচ্ছে مَاظَهَرَمِنْهَا অর্থাৎ নারীর কোন সাজ-সজ্জার অঙ্গ পুরুষের সামনে প্রকাশ করা বৈধ নয়, অবশ্য সেসব অঙ্গ ব্যতীত, যেগুলো আপনা-আপনি প্ৰকাশ হয়ে পড়ে অর্থাৎ কাজকর্ম ও চলাফেরার সময় সেসব অঙ্গ স্বভাবতঃ খুলেই যায়। এগুলো ব্যতিক্রমের অন্তর্ভুক্ত। এগুলো প্ৰকাশ করার মধ্যে কোন গোনাহ নেই। এ সম্পর্কে আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ ও আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমের তাফসীর দু’ধরনের। ইবনে মাসউদ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা বলেনঃ مَاظَهَرَمِنْهَا বাক্যে উপরের কাপড়; যেমন বোরকা, লম্বা চাদর ইত্যাদিকে ব্যতিক্রমের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এগুলো সাজ-সজ্জার পোশাককে আবৃত রাখার জন্য পরিধান করা হয়। আয়াতের অর্থ এই যে, প্রয়োজনবশতঃ বাইরে যাওয়ার সময় যেসব উপরের কাপড় আবৃত করা সম্ভবপর নয়, সেগুলো ব্যতীত সাজ-সজ্জার কোন বস্তু প্ৰকাশ করা জায়েয নয়। আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমাও বলেনঃ এখানে প্রকাশ্য সৌন্দর্য বলতে চেহারা, চোখের সুরমা, হাতের মেহেদী বা রঙ এবং আংটি। সুতরাং এগুলো সে তার ঘরে যে সমস্ত মানুষ তার কাছে প্ৰবেশ করার অনুমতি আছে, তাদের সামনে প্ৰকাশ করবে।
কোন কোন মুফাসসির এ আয়াতের তাফসীরে বলেনঃ নারীর আসল বিধান এই যে, সে তার সাজ-সজ্জার কোন কিছুই প্ৰকাশ করবে না। আয়াতের উদ্দেশ্যও তাই। তবে চলাফেরা ও কাজকর্মে স্বভাবতঃ যেগুলো খুলে যায়, সেগুলো অপারগতার কারণে গোনাহ থেকে মুক্ত। নারী কোন প্রয়োজনে বাইরে বের হলে বোরকা, চাদর ইত্যাদি প্রকাশ হয়ে পড়া সুনির্দিষ্ট। লেন-দেনের প্রয়োজনে কোন সময় মুখমণ্ডল ও হাতের তালুও প্রকাশ হয়ে পড়ে। এটাও ক্ষমার্হ- গোনাহ নয়। পক্ষান্তরে কোন কোন মুফাসসির اِلَّامَاظَهَرَمِنْهَا এর অর্থ নিয়েছেনঃ “মানুষ স্বাভাবিকভাবে যা প্ৰকাশ করে দেয়” এবং তারপর তারা এর মধ্যে শামিল করে দিয়েছেন মুখ ও হাতকে তাদের সমস্ত সাজসজ্জাসহ। [দেখুন-তাবারী, ইবন কাসীর, ফাতহুল কাদীর, সহীহ আল-মাসবুর]
[৫] অর্থাৎ তারা যেন বক্ষদেশে ওড়না ফেলে রাখে। خُمُر শব্দটি خمار এর বহুবচন। অর্থ ঐ কাপড়, যা নারী মাথায় ব্যবহার করে এবং তা দ্বারা গলা ও বক্ষ আবৃত হয়ে যায়। خيوب শব্দটি خيب এর বহুবচন- এর অর্থ জামার কলার। [কুরতুবী, ফাতহুল কাদীর] জাহেলী যুগে মহিলারা মাথায় এক ধরনের আঁটসাঁট বাঁধন দিতো। মাথার পেছনে চুলের খোঁপার সাথে এর গিরো বাঁধা থাকতো। সামনের দিকে বুকের একটি অংশ খোলা থাকতো। সেখানে গলা ও বুকের উপরের দিকের অংশটি পরিষ্কার দেখা যেতো। বুকে জামা ছাড়া আর কিছুই থাকতো না। পেছনের দিকে দুটো তিনটে খোঁপা দেখা যেতো। তাই মুসলিম নারীদেরকে আদেশ করা হয়েছে তারা যেন এরূপ না করে; বরং ওড়নার উভয় প্রান্ত পরস্পর উল্টিয়ে রাখে, এতে করে যেন সকল অঙ্গ আবৃত হয়ে পড়ে। [ইবন কাসীর] আয়াত নাযিল হবার পর মুসলিম মহিলাদের মধ্যে ওড়নার প্রচলন করা হয়। মু’মিন মহিলারা কুরআনের এ হুকুমটি শোনার সাথে সাথে যেভাবে একে কার্যকর করে আয়েশা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা তার প্রশংসা করে বলেনঃ সূরা নূর নাযিল হলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মুখ থেকে
وَلْيَضْرِبْنَ جِخُمُرِهِنَّ عَلىٰ جُيُوْبِهِنَّ
বাক্যাংশ শোনার পর তারা নিজের কোমরে বাঁধা কাপড় খুলে নিয়ে আবার অনেকে চাদর তুলে নিয়ে সংগে সংগেই ওড়না বানিয়ে ফেলল এবং তা দিয়ে শরীর ঢেকে ফেললো। [বুখারীঃ ৪৭৫৯] অন্য বর্ণনায় এসেছে, উম্মে সালামাহ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা বলেন, যখন
وَلْيَضْرِبْنَ جِخُمُرِهِنَّ عَلىٰ جُيُوْبِهِنَّ
এ আয়াত নাযিল হলো, তখন তাদের মাথা এমনভাবে কালো কাপড় দিয়ে ঢেকে ফেলল মনে হয় যেন তাদের মাথার উপর কাক রয়েছে। [আবু দাউদঃ ৪১০১] এ সম্পর্কিত অন্য একটি হাদীসে আয়েশা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা আরো বিস্তারিত বর্ণনা করে বলেনঃ আল্লাহ্ প্রথম যুগের মুহাজির মহিলাদের উপর রহমত নাযিল করুন তারা
وَلْيَضْرِبْنَ جِخُمُرِهِنَّ عَلىٰ جُيُوْبِهِنَّ
নাযিল হওয়ার পরে পাতলা কাপড় পরিত্যাগ করে নিজেদের মোটা কাপড় বাছাই করে তা দিয়ে ওড়না তৈরী করে। [আবু দাউদঃ ৪১০২]
[৬] পর্দার বিধান থেকে পরবর্তী ব্যতিক্রম হলো আল্লাহ্র বাণীঃ اَوْنِسَآىِٕهِنَّ অর্থাৎ নিজেদের স্ত্রীলোক; এর উদ্দেশ্য মুসলিম স্ত্রীলোক। তাদের সামনেও এমনসব অঙ্গ খোলা যায়, যেগুলো নিজ পিতা ও পুত্রের সামনে খোলা যায়। [ইবন কাসীর]
তবে আয়াতে ‘তাদের নিজেদের স্ত্রীলোক’ বলা থেকে জানা গেল যে, কাফের মুশরিক স্ত্রীলোকরা পর্দার হুকুমের ব্যতিক্রম নয়। তাদের সাথে পর্দা করা প্রয়োজন। তারা বেগানা পুরুষদের বিধানের অন্তর্ভুক্ত। এই আয়াতের তাফসীর প্রসঙ্গে ইবনে কাসীর মুজাহিদ থেকে বর্ণনা করেনঃ এ থেকে জানা গেল যে, কাফের নারীদের সামনে অঙ্গ প্রকাশ করা কোন মুসলিম নারীর জন্য জায়েয নয়। কিন্তু সহীহ হাদীসসমূহে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লামের স্ত্রীদের সামনে কাফের নারীদের যাতায়াত প্রমাণিত আছে। তাই এ প্রশ্নে মুজতাহিদ ইমামগণের মধ্যে মতভেদ বিদ্যমান। কারো মতে কাফের নারী বেগানা পুরুষদের মত। কেউ কেউ এ ব্যাপারে মুসলিম ও কাফের উভয় প্রকার নারীর একই বিধান রেখেছেন; অর্থাৎ তাদের কাছে পর্দা করতে হবে না । [দেখুন-বাগভী, ফাতহুল কাদীর]
(৭) একাদশ প্রকার
اَوِالتّٰبِعِيْنَ عَيْرِاوُلىِ الْاِرْبَةِمِنَ الرِّجِالِ
আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা বলেনঃ এখানে এমন নির্বোধ ও ইন্দ্রিয়বিকল ধরনের লোকদের বুঝানো হয়েছে, যাদের নারী জাতির প্রতি কোন আগ্রহ ও ঔৎসুক্যই নেই। ইবনে জরীর তাবারী একই বিষয়বস্তুই আবু আব্দুল্লাহ, ইবনে জুবায়র, ইবনে আতিয়্যা প্রমুখ থেকে বর্ণনা করেছেন। কাজেই আয়াতে এমনসব পুরুষকে বুঝানো হয়েছে, যাদের মধ্যে নারীদের প্রতি কোন আগ্রহ ও কামভাব নেই এবং নারীদের রূপ-গুণের প্রতিও তাদের কোন ঔৎসুক্য নেই যে, অপরের কাছে গিয়ে বর্ণনা করবে।
তবে নপুংসক ধরনের লোক যারা নারীদের বিশেষ গুণাবলীর সাথে সম্পর্ক রাখে, তাদের কাছেও পর্দা করা ওয়াজিব। আয়েশা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা বর্ণিত হাদীসে আছে, জনৈক খুনসা বা হিজড়া ব্যাক্তি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের স্ত্রীদের কাছে আসা-যাওয়া করত। রাসূলের স্ত্রীগণ তাকে আয়াতে বর্ণিত
عَيْرِاوُلىِ الْاِرْبَةِمِنَ الرِّجِالِ
এর অন্তর্ভুক্ত মনে করে তার সামনে আগমন করতেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম তখন তাকে গৃহে প্রবেশ করতে নিষেধ করে দিলেন। [দেখুন, মুসলিমঃ ২১৮০] এ কারণেই কোন কোন আলেম বলেনঃ পুরুষ যদিও পুরুষত্বহীন, লিঙ্গকর্তিত অথবা খুব বেশী বৃদ্ধ হয়, তবুও সে عَيْرِاوُلىِ الْاِرْبَةِ শব্দের অন্তর্ভুক্ত নয়। তার কাছে পর্দা করা ওয়াজিব। এখানে عَيْرِاوُلىِ الْاِرْبَةِ শব্দের সাথে اَوِالتّٰبِعِيْنَ শব্দ উল্লেখ করা হয়েছে। উদ্দেশ্য এই যে, নির্বোধ ইন্দ্রিয়বিকল লোক, যারা অনাহূত গৃহে ঢুকে পড়ে, তারা ব্যতিক্রমভুক্ত। [দেখুন-তাবারী, কুরতুবী, ফাতহুল কাদীর]
(৮) দ্বাদশ প্রকার اَوِلطِّفْلِ এখানে এমন অপ্রাপ্তবয়স্ক বালককে বুঝানো হয়েছে, যে এখনো সাবালকত্বের নিকটবর্তীও হয়নি এবং নারীদের বিশেষ আকর্ষণ, কমনীয়তা ও গতিবিধি সম্পর্কে সম্পূর্ণ বেখবর। যে বালক এসব অবস্থা সম্পর্কে সচেতন, সে ‘মোরাহিক' অর্থাৎ সাবালকত্বের নিকটবর্তী। তার কাছে পর্দা করা ওয়াজিব। [ইবন কাসীর]
(৯) অর্থাৎ নারীরা যেন সজোরে পদক্ষেপ না করে, যার দরুন অলঙ্কারাদির আওয়াজ ভেসে উঠে এবং তাদের বিশেষ সাজ-সজ্জা পুরুষদের কাছে উদ্ভাসিত হয়ে উঠে। [ফাতহুল কাদীর]। এখানে মূল উদ্দেশ্য নিজেদের অঙ্গ-প্রত্যাঙ্গাদি ও সেগুলোর সৌন্দর্য প্রকাশ হয়ে পড়ার যাবতীয় বস্তুই নিষেধ করা। অনুরূপভাবে দৃষ্টি ছাড়া অন্যান্য ইন্দ্রিয়গুলোকে উত্তেজিতকারী জিনিসগুলোও আল্লাহ্ তা‘আলা মহিলাদেরকে যে উদ্দেশ্যে সাজসজ্জা ও সৌন্দর্যের প্রকাশনী করতে নিষেধ করেছেন তার বিরোধী। তাই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মহিলাদেরকে খোশবু লাগিয়ে বাইরে বের না হবার হুকুম দিয়েছেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ “আল্লাহ্র দাসীদেরকে আল্লাহ্র মসজিদে আসতে নিষেধ করো না। কিন্তু তারা যেন খোশবু লাগিয়ে না আসে।” [আবু দাউদঃ ৫৬৫, মুসনাদে আহমাদঃ ২/৪৩৮] অন্য একটি হাদীসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন “যে মেয়ে মসজিদে খোশবু মেখে আসে তার সালাত ততক্ষণ কবুল হয় না যতক্ষণ না সে বাড়ি ফিরে ফরয গোসলের মত গোসল করে।” [আবু দাউদঃ ৪১৭৪, ইবনে মাজাহঃ ৪০০২, মুসনাদে আহমাদঃ ২/২৪৬] আবু মূসা আশআরী বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেনঃ “যে নারী আন্তর মেখে পথ দিয়ে যায়, যাতে লোকেরা তার সুবাসে বিমোহিত হয়, সে এমন ও এমন। তিনি তার জন্য খুবই কঠিন শব্দ ব্যবহার করেছেন।” [আবু দাউদঃ ৪১৭৩, মুসনাদে আহমাদঃ ৪/৪০০]।
তদ্রুপ নারীরা প্রয়োজন ছাড়া নিজেদের আওয়াজ পুরুষদেরকে শোনাবে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এটাও অপছন্দ করতেন। প্রয়োজনে কথা বলার অনুমতি কুরআনেই দেয়া হয়েছে এবং নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পবিত্ৰ স্ত্রীগণ নিজেরাই লোকদেরকে দ্বীনী মাসায়েল বর্ণনা করতেন। কিন্তু যেখানে এর কোন প্রয়োজন নেই এবং কোন দ্বীনী বা নৈতিক লাভও নেই সেখানে মহিলারা নিজেদের আওয়াজ ভিন্ পুরুষদেরকে শুনাবে এটা পছন্দ করা হয়নি। কাজেই সালাতে যদি ইমাম ভুলে যান তাহলে পুরুষদেরকে সুবহানাল্লাহ বলার হুকুম দেয়া হয়েছে কিন্তু মেয়েদেরকে এক হাতের উপর অন্য হাত মেরে ইমামকে সতর্ক করে দেবার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। [দেখুন, বুখারীঃ ১২০৩, মুসলিমঃ ৪২১, ৪২২]।
(১০) অর্থাৎ মুমিনগণ, তোমরা সবাই আল্লাহ্র কাছে তাওবাহ কর। [কুরতুবী] হাদীসে এসেছে, তাওবাহ হলো, অনুতপ্ত হওয়া, অনুশোচনা করা, [ইবনে মাজাহঃ ৪২৫২]
এ বিধানগুলো নাযিল হবার পর কুরআনের মর্মবাণী অনুযায়ী নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইসলামী সমাজে অন্য যেসব সংস্কারমূলক বিধানের প্রচলন করেন তন্মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি হচ্ছেঃ
একঃ মাহরাম আত্মীয়ের অনুপস্থিতিতে অন্য লোকেরা (আত্মীয় হলেও) কোন মেয়ের সাথে একাকী সাক্ষাত করতে ও তার কাছে নির্জনে বসতে পারে না। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ “যেসব নারীর স্বামী বাইরে গেছে তাদের কাছে যেয়ো না। কারণ শয়তান তোমাদের মধ্য থেকে প্রত্যেকের রক্ত ধারায় আবর্তন করছে।” [তিরমিযীঃ ১১৭২] রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরো বলেছেনঃ “যে ব্যক্তি আল্লাহ্ ও আখেরাতের দিনের প্রতি ঈমান রাখে সে যেন কখনো কোন মেয়ের সাথে নির্জনে সাক্ষাৎ না করে যতক্ষণ না ঐ মেয়ের কোন মাহরাম তার সাথে থাকে। কারণ সে সময় তৃতীয়জন থাকে শয়তান।” [মুসনাদে আহমাদঃ ১/১৮]
দুইঃ কোন পুরুষের হাত কোন গায়ের মাহরাম মেয়ের গায়ে লাগুক এটাও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বৈধ করেননি। তাই তিনি পুরুষদের হাতে হাত রেখে বাই‘আত করতেন। কিন্তু মেয়েদের বাই‘আত নেবার সময় কখনো এ পদ্ধতি অবলম্বন করতেন না। আয়েশা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা বলেন, “নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হাত কখনো কোন ভিন মেয়ের শরীরে লাগেনি। তিনি মেয়েদের থেকে শুধুমাত্ৰ মৌখিক শপথ নিতেন এবং শপথ নেয়া শেষ হলে বলতেন, যাও তোমাদের বাই‘আত হয়ে গেছে।” [বুখারীঃ ৫২৮৮, মুসলিমঃ ১৮৬৬]
তিনঃ মেয়েদের মাহরাম ছাড়া একাকী অথবা গায়ের মাহরামের সাথে সফর করতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কঠোরভাবে নিষেধ করতেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ “কোন পুরুষ যেন মহিলার সাথে একান্তে সাক্ষাৎ না করে যতক্ষণ তার সাথে তার মাহরাম না থাকে এবং কোন মহিলা যেন সফর না করে যতক্ষণ না তার কোন মাহরাম তার সাথে থাকে।” [বুখারীঃ ১৮৬২, ৩০০৬, ৩০৬১, ৫২৩৩, মুসলিমঃ ১৩৪১]
____________________
[১] أيامى শব্দটি أيّم এর বহুবচন। অর্থ প্রত্যেকটি এমন নর ও নারী, যার বিয়ে বর্তমান নেই; একেবারেই বিয়ে না করার কারণে হোক কিংবা বিয়ের পর স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে একজনের মৃত্যু অথবা তালাকের কারণে হোক। [দেখুন-বাগভী] এমন নর ও নারীদের বিয়ে সম্পাদনের জন্য তাদের অভিভাবকদেরকে আদেশ করা হয়েছে। বিয়ে করার প্রতি উৎসাহ দিয়ে বিভিন্ন হাদীসেও নির্দেশ এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ ‘যাদের বিয়ে সম্পন্ন হয়েছিল এমন মহিলাদের পুনরায় বিয়ে দিতে হলে তার সরাসরি স্পষ্টভাষায় মতামত না নিয়ে বিয়ে দেয়া যাবে না। আর যাদের বিয়ে ইতিপূর্বে হয়নি, তাদের বিয়েতেও অনুমতি নিতে হবে। সাহাবাগণ বললেনঃ হে আল্লাহ্র রাসূল, তার অনুমতি কিভাবে নিবে? তিনি জবাব দিলেনঃ চুপ থাকা। [বুখারীঃ ৫১৩৬, মুসলিমঃ ১৪১৯] অন্য বর্ণনায় আনাস ইবনে মালেক রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেনঃ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিয়ের নির্দেশ দিতেন, বৈরাগ্যপনা (অবিবাহিত থাকা) থেকে কঠোরভাবে নিষেধ করতেন এবং বলতেনঃ ‘যারা স্বামীকে ভালবাসবে এবং বেশি সন্তান জন্ম দেয় এমন মেয়েদের তোমরা বিয়ে কর। কেননা, আমি কেয়ামতের দিন নবীদের কাছে বেশী সংখ্যা দেখাতে পারব।’ [ইবনে হিব্বানঃ ৪০২৮, মুসনাদে আহমাদঃ ৩/১৫৮, ২৪৫]
[২] অর্থাৎ নারীদেরকে বিয়েতে বাধা না দেয়ার জন্য অভিভাবকদের জন্য অপরিহার্য। এক হাদীসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামও বলেছেনঃ ‘তোমাদের কাছে যদি কেউ বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আসে, তবে তার চরিত্র পছন্দনীয় হলে অবশ্যই বিয়ে সম্পাদন করে দাও। এরূপ না করলে দেশে বিপুল পরিমাণে অনর্থ দেখা দেবে।’ [তিরমিযীঃ ১০৮৪, ১০৮৫]
____________________
[১] অর্থাৎ যারা অর্থ-সম্পদের দিক দিয়ে বিয়ের সামর্থ্য রাখে না এবং বিয়ে করলে আশঙ্কা আছে যে, স্ত্রীর অধিকার আদায় না করার কারণে গোনাহগার হয়ে যাবে, তারা যেন পবিত্রতা ও ধৈর্যসহকারে অপেক্ষা করে, যে পর্যন্ত না আল্লাহ্ তা‘আলা স্বীয় অনুগ্রহে তাদেরকে সম্পদশালী বানিয়ে দেন। বিয়ে করার কারণে আল্লাহ্ তা‘আলার পক্ষ থেকে ধনাঢ্যতা দান করার ওয়াদা তখন, যখন পবিত্ৰতা সংরক্ষণ ও সুন্নাত পালনের নিয়তে তা সম্পাদন করা হয়, অতঃপর আল্লাহ্র উপর তাওয়াক্কুল ও ভরসা করা হয়। [দেখুন-কুরতুবী] এই ধৈর্যের জন্য হাদীসে একটি কৌশলও বলে দেয়া হয়েছে যে, তারা বেশী পরিমানে সিয়াম পালন করবে। তারা এরূপ করলে আল্লাহ্ তা‘আলা স্বীয় অনুগ্রহে তাদেরকে বিয়ের সামর্থ্য পরিমানে অর্থ-সম্পদ দান করবেন। এ প্রসংগে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে যে হাদীসগুলো বর্ণিত হয়েছে সেগুলোই এ আয়াতগুলোর সবচেয়ে ভালো ব্যাখ্যা করতে পারে। যেমন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ “হে যুবকগণ! তোমাদের মধ্য থেকে যে বিয়ে করতে পারে তার বিয়ে করে নেয়া উচিত। কারণ এটি হচ্ছে চোখকে কুদৃষ্টি থেকে বাঁচাবার এবং মানুষের সততা ও চারিত্রিক পবিত্ৰতা রক্ষার উৎকৃষ্ট উপায়। আর যার বিয়ে করার ক্ষমতা নেই তার সাওম পালন করা উচিত। কারণ সাওম মানুষের দেহের উত্তাপ ঠাণ্ডা করে দেয়।” [বুখারীঃ ১৯০৫, মুসলিমঃ ১০১৮] রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরো বলেনঃ “তিন ব্যাক্তিকে সাহায্য করা আল্লাহ্র দায়িত্ব। এক ব্যাক্তি হচ্ছে, যে চারিত্রিক বিশুদ্ধতা বজায় রাখার জন্য বিয়ে করে। দ্বিতীয় ব্যাক্তি হচ্ছে, মুক্তিলাভের জন্য যে গোলাম লিখিতভাবে চুক্তিবদ্ধ হয় এবং তার মুক্তিপণ দেবার নিয়ত রাখে। আর তৃতীয় ব্যাক্তি, যে আল্লাহ্র পথে জিহাদ করার জন্য বের হয়।” [তিরমিযীঃ ১৬৫৫, নাসাঈঃ ৬/১৫, ইবনে মাজাহঃ ২৫১৮, আহমাদঃ ২/২৫১]
[২] এ আয়াতে বর্ণিত, “আর তোমাদের দাসীরা লজ্জাস্থানের পবিত্ৰতা রক্ষা করতে চাইলে দুনিয়ার জীবনের ধন-লালসায় তাদেরকে ব্যভিচারে বাধ্য করো না।” এখানে “লজ্জাস্থানের পবিত্ৰতা রক্ষা করতে চাইলে” কথাটি শর্ত হিসেবে ব্যবহৃত হয়নি। বরং সাধারণ নিয়মের কথাই বলা হয়েছে। কারণ, সাধারণতঃ পবিত্ৰা মেয়েদেরকে জোর জবরদস্তি ছাড়া অন্যায় কাজে প্রবৃত্ত করা যায় না। [ফাতহুল কাদীর] আয়াতে পরবর্তীতে বলা হয়েছে, “আর যারা তাদেরকে বাধ্য করবে, নিশ্চয় তাদেরকে বাধ্য করার পর আল্লাহ্ তো ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।” এখানেও এ মেয়েদেরকে ক্ষমা করার কথা বলা হয়েছে। যবরদস্তিকারীদেরকে নয়। যবরদস্তিকারীদের গোনাহ অবশ্যই হবে। তবে যাদের উপর যবরদস্তি করা হয়েছে আল্লাহ্ তাদের প্রতি ক্ষমাশীল। [ফাতহুল কাদীর]
____________________
[১] নূরের সংজ্ঞাঃ নূর শব্দের আভিধানিক অর্থ আলো। [ফাতহুল কাদীর] কুরআন ও হাদীসে আল্লাহ্র জন্য নূর কয়েকভাবে সাব্যস্ত হয়েছে।
এক) আল্লাহ্র নাম হিসাবে। যে সমস্ত আলেমগণ এটাকে আল্লাহ্র নাম হিসাবে সাব্যস্ত করেছেন তারা হলেন, সুফিয়ান ইবনে উ‘য়াইনাহ খাত্তাবী, ইবনে মান্দাহ, হালিমী, বাইহাকী, ইস্পাহানী, ইবনে আরাবী, কুরতুবী, ইবনু তাইমিয়াহ, ইবনুল কাইয়্যেম, ইবনুল ওয়ায়ীর, ইবনে হাজার, আস-সা‘দী, আল-কাহতানী, আল-হামুদ, আশ-শারবাসী, নূরুল হাসান খান প্রমুখ।
দুই) আল্লাহ্র গুণ হিসাবে। আল্লাহ্ তা‘আলা নূর নামক গুণ তাঁর জন্য বিভিন্ন ভাবে সাব্যস্ত করেছেন। যেমন-
(ক) কখনো কখনো সরাসরি নূরকে তাঁর দিকে সম্পর্কিত করেছেন। আল্লাহ্ বলেনঃ مَثَلُ نُوْرِهٖ كَمِشْكوٰةٍ অর্থাৎ “আল্লাহ্র নূরের উদাহরণ হলো...। অন্য আয়াতে আল্লাহ্ বলেনঃ وَاَشْرَقَتِ الْاَرْضُ بِنُوْرِرَبِّهَا অর্থাৎ “আর আলোকিত হলো যমীন তার প্রভূর আলোতে।” [সূরা আয-যুমারঃ ৬৯] হাদীসে এসেছে, ‘আল্লাহ্ তা‘আলা তার সৃষ্টিকে অন্ধকারে সৃষ্টি করেছেন। তারপর তিনি তাতে তাঁর নূরের কিছু ঢেলে দিলেন। সুতরাং এ নূরের কিছু অংশ যার উপরই পড়েছে, সে হেদায়াত লাভ করেছে। আর যার উপর পড়েনি সে পথভ্রষ্ট হয়েছে।’ [তিরমিযীঃ ২৬৪২]
(খ) কখনো কখনো আল্লাহ্ তা‘আলা তাঁর এ নূরকে তার চেহারার দিকে সম্পর্কযুক্ত করেছেন। আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেনঃ ‘আসমান ও যমীনের যাবতীয় নূর তাঁরই চেহারার আলো। [আবু সাইদ আদ-দারেমী]
তিন) আল্লাহ্র নূরকে আসমান ও যমীনের দিকে সম্পর্কযুক্ত করে বর্ণনা করা হয়েছে। আল্লাহ্ তা‘আলা বলেনঃ
اَللهُ نُوْرْالسَّمٰوٰتِ وَالْاَرْضِ
অর্থাৎ “আল্লাহ্ আসমান ও যমীনের নূর।” এক হাদীসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ
اللّٰهُمَّ لَكَ ا احَمْدُ أَنْتَ نُوْرُ السَّمٰوَاتِ وَالأَرْضِ وَمَنْ فِيْهِنَّ
অর্থাৎ ‘হে আল্লাহ্, আপনার জন্য সমস্ত প্রশংসা, আপনি আসমান ও যমীনের আলো এবং এ দু’য়ের মধ্যে যা আছে তারও (আলো)...। [বুখারীঃ ১১২০, মুসলিমঃ ১৯৯]
চার) আল্লাহ্র পর্দাও নূর। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ ‘তাঁর পর্দা হলো নূর।’ [মুসলিমঃ ২৯৩] আর আল্লাহ্র রাসূল সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম মি‘রাজের রাতে এর নূরই দেখেছিলেন। সাহাবাগণ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞাসা করেছিলেনঃ ‘আপনি কি আপনার প্রভূকে দেখেছিলেন? তিনি বললেনঃ নূর! কিভাবে তাকে দেখতে পারি?’ [মুসলিমঃ ২৯১] অপর বর্ণনায় এসেছে, ‘আমি নূর দেখেছি।’ [মুসলিমঃ ২৯২] এ হাদীসের সঠিক অর্থ হলো, আমি কিভাবে তাঁকে দেখতে পাব? সেখানে তো নূর ছিল। যা তাকে দেখার মাঝে বাঁধা দিচ্ছিল। আমি তো কেবল নূর দেখেছি। সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে, আল্লাহ্র পর্দাও নূর। এ নূরের পর্দার কারণেই সবকিছু পুড়ে যাচ্ছে না। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ ‘যদি তিনি তাঁর পর্দা খুলতেন তবে তাঁর সৃষ্টির যতটুকুতে তাঁর নজর পড়ত সবকিছু তাঁর চেহারার আলোর কারণে পুড়ে যেত।’ [মুসলিমঃ ২৯৩-২৯৫]
সুতরাং আসমান ও যমীনের প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য দু‘ধরনের নূরই আল্লাহ্র। প্রকাশ্য নূর যেমন- আল্লাহ্ তা‘আলা স্বয়ং নূর। তাঁর পর্দা নূরের। যদি তিনি তাঁর সে পর্দা উন্মোচন করেন, তাহলে তাঁর সৃষ্টির যতটুকুতে তাঁর দৃষ্টি পড়বে তার সবকিছুই ভস্ম হয়ে যাবে। তাঁর নূরেই আরশ আলোকিত। তাঁর নূরেই কুরসী, সূর্য, চাদ ইত্যাদি আলোকিত। অনুরূপভাবে তাঁর নূরেই জান্নাত আলোকিত। কারণ, সেখানে তো আর সূর্য নেই।
আর অপ্রকাশ্য নূর যেমন- আল্লাহ্র কিতাব নূর [সূরা আল-আ‘রাফঃ ১৫৭], তাঁর শরীয়ত নূর [সূরা আল-মায়েদাঃ ৪৪], তাঁর বান্দা ও রাসূলদের অন্তরে অবস্থিত ঈমান ও জ্ঞান তাঁরই নূর [সূরা আয-যুমারঃ ২২]। যদি এ নূর না থাকত তাহলে অন্ধকারের উপর অন্ধকারে সবকিছু ছেয়ে যেত। সুতরাং যেখানেই তাঁর নূরের অভাব হবে সেখানেই অন্ধকার ও বিভ্ৰান্তি দানা বেঁধে থাকে। আর এজন্যই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম দো‘আ করতেনঃ ‘হে আল্লাহ্, আমার অন্তরে নূর দিন, আমার শ্রবণেন্দ্রীয়ে নূর দিন, আমার দৃষ্টিশক্তিতে নূর দিন, আমার ডানে নূর দিন, আমার বামে নূর দিন, আমার সামনে নূর দিন, আমার পিছনে নূর দিন, আমার উপরে নূর দিন, আমার নীচে নূর দিন। আর আমার জন্য নূর দিন অথবা বলেছেনঃ আমাকে নূর বানিয়ে দিন। অন্য বর্ণনায় এসেছে, আর আমার জন্য আমার আত্মায় নূর দিন। আমার জন্য বৃহৎ নূরের ব্যবস্থা করে দিন। [বুখারীঃ ৬৩১৬, মুসলিমঃ ৭৬৩]
অন্য বর্ণনায় এসেছে, রাসূল সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ ‘হে আল্লাহ্, আমাকে নূর দিন, আমার জন্য আমার অস্থি ও শিরা-উপশিরায় নূর দিন। আমার মাংসে নুর দিন, আমার রক্তে নূর দিন, আমার চুলে নূর দিন, আমার শরীরে নূর দিন।’ অপর বর্ণনায় এসেছে, ‘হে আল্লাহ্, আমার জন্য আমার কবরে নূর দিন। আমার হাড্ডিতে নূর দিন।’ [তিরমিযীঃ ৩৪১৯] অন্যত্র এসেছে, ‘আর আমার নূর বাড়িয়ে দিন, আমার নূর বাড়িয়ে দিন, আমার নূর বাড়িয়ে দিন। [বুখারীঃ আদাবুল মুফরাদ- ৬৯৫] ‘আমাকে নূরের উপর নূর দান করুন।’ [ফাতহুল বারীঃ ১১/১১৮]
আয়াতে আল্লাহ্ তা‘আলা সত্তার জন্য ব্যবহৃত ‘নূর’ শব্দটির অর্থ কোন কোন তাফসীরবিদের মতে ‘মুনাওয়ের' অর্থাৎ ঔজ্জ্বল্যদানকারী। অথবা অতিশয়ার্থবোধক পদের ন্যায় নূরওয়ালাকে নূর বলে ব্যক্ত করা হয়েছে। তখন আয়াতের অর্থ হয় যে, আল্লাহ্ তা‘আলা নভোমণ্ডল, ভূমণ্ডল ও এতদুভয়ের মধ্যে বসবাসকারী সব সৃষ্টজীবের নূরদাতা। এই নূর বলে হেদায়াতের নূর বুঝানো হয়েছে। [দেখুন- বাগভী] ইবনে কাসীর ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে এর তাফসীর এরূপ বর্ণনা করেছেনঃ
اللّٰهُ هَادِى أَهْلِ السَّمَا وَاتِ وَالْاَرْضِ
অর্থাৎ আল্লাহ্ নভোমণ্ডল ও ভূমণ্ডলের অধিবাসীদের হেদায়াতকারী। [ইবন কাসীর]
[২] مَثَلُ ذُوْرِهٖ এর সর্বনাম দ্বারা কাকে বুঝানো হয়েছে, এ সম্পর্কে তাফসীরবিদগণের কয়েকটি উক্তি এসেছেঃ
(এক) এই সর্বনাম দ্বারা আল্লাহ্ তা‘আলাকে বুঝানো হয়েছে। আয়াতের অর্থ এই যে, আল্লাহ্র নূর হেদায়াত যা মুমিনের অন্তরে রাখা হয়েছে, তার দৃষ্টান্ত كَمِشْكَاةٍ এটা ইবনে-আব্বাসের উক্তি। অর্থাৎ মুমিনের অন্তরস্থিত কুরআন ও ঈমানের মাধ্যমে সঞ্চিত আল্লাহ্র নূরকে তুলনা করে বলা হচ্ছে যে, এ নূরের উদাহরণ হলো এমন একটি তাকের মত যেখানে আল্লাহ্র নূর আলোর মত উজ্জল ও সদা বিকিরনশীল। সে হিসেবে আয়াতের প্রথমে আল্লাহ্ তা‘আলা নিজের নূর উল্লেখ করেছেন
اللهُ نُوْرُالسَّمٰوٰتِ وَالْاارضِ
অতঃপর মুমিনের অন্তরে অবস্থিত তাঁরই নূর উল্লেখ করেছেন مَثَلُ نُوْرِهٖ -উবাই ইবনে কা‘ব এই আয়াতের কেরাআতও مَثَلُ نُوْرِهٖ এর পরিবর্তে
مَثَلُ نُوْرِمَنْ آمَنَ بِهِ
পড়তেন। সাঈদ ইবনে যুবায়ের এই কেরাআত এবং আয়াতের এই অর্থ ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা থেকেও বর্ণনা করেছেন।
(দুই) এই সর্বনাম দ্বারা মুমিনকেই বুঝানো হয়েছে। তখন দৃষ্টান্তের সারমর্ম এই যে, মুমিনের বক্ষ একটি তাকের মত এবং এতে তার অন্তর একটি প্রদীপ সদৃশ। এতে যে স্বচ্ছ যয়তুন তৈলের কথা বলা হয়েছে, এটা মুমিনের স্বভাবে গচ্ছিত রাখা নূরে ঈমানের দৃষ্টান্ত। এর বৈশিষ্ট্য আপনা-আপনি সত্যকে গ্ৰহণ করা। যয়তুন তৈল অগ্নি স্পর্শে প্ৰজ্বলিত হয়ে যেমন অপরকে আলোকিত করে, এমনিভাবে মুমিনের অন্তরে রাখা নূরে-হেদায়াত যখন আল্লাহ্র ওহী ও জ্ঞানের সাথে মিলিত হয়, তখন আলোকিত হয়ে বিশ্বকে আলোকিত করে দেয়। সাহাবায়ে কেরাম ও তাবেয়ীগণ এই দৃষ্টান্তকে বিশেষভাবে মুমিনের অন্তরের সাথে সম্পর্কযুক্ত করেছেন। এর কারণও সম্ভবতঃ এই যে, এই নূর দ্বারা শুধু মুমিনই উপকার লাভ করে। নতুবা এই সৃষ্টিগত হেদায়াতের নূর যা সৃষ্টির সময় মানুষের অন্তরে রাখা হয়, তা বিশেষভাবে মুমিনের অন্তরেই রাখা হয় না; বরং প্রত্যেক মানুষের মজ্জায় ও স্বভাবে এই হেদায়াতের নূর রাখা হয়। এরই প্রতিক্রিয়া জগতের প্রত্যেক জাতি, প্রত্যেক ভূখণ্ড এবং প্রত্যেক ধর্মাবলম্বীর মধ্যে পরিদৃষ্ট হয় যে, তারা আল্লাহ্র অস্তিত্ব ও তাঁর মহান কুদরতের প্রতি সৃষ্টিগতভাবে বিশ্বাস রাখে এবং তাঁর দিকে প্রত্যাবর্তন করে। তারা আল্লাহ্ তা‘আলা সম্পর্কিত ধারণা ও ব্যাখ্যায় যত ভুলই করুক, কিন্তু আল্লাহ্র অস্তিত্ব সম্পর্কে প্রত্যেক মানুষ সৃষ্টিগতভাবেই বিশ্বাসী। তবে কিছুসংখ্যক বস্তুবাদীর কথা ভিন্ন। তাদের স্বভাবধর্মই বিকৃত হয়ে গেছে। ফলে তারা আল্লাহ্র অস্তিত্বই অস্বীকার করে। একটি সহীহ হাদীস থেকে এই ব্যাপক অর্থের সমর্থন পাওয়া যায়। এতে বলা হয়েছে,
كُلُّ مَوْلُوْدٍ قُوْلَدُ عَلَى الْفِطْرَةِ
অর্থাৎ “প্রত্যেকটি শিশু ফিতরতের উপর জন্মগ্রহণ করে।’’ [বুখারীঃ ২৪৪, মুসলিমঃ ২৬৫৮] এরপর তার পিতামাতা তাকে ফিতরতের দাবী থেকে সরিয়ে ভ্রান্ত পথে পরিচালিত করে। এই ফিতরতের অর্থ ঈমানের হেদায়াত। ঈমানের হেদায়াত ও তার নূর প্রত্যেক মানুষকে সৃষ্টি করার সময় তার মধ্যে রাখা হয়। যখন নবী ও তাদের নায়েবদের মাধ্যমে তাদের কাছে ওহীর জ্ঞান পৌঁছে, তখন তারা সহজেই তা গ্ৰহণ করে নেয়। তবে স্বভাবধর্ম বিকৃত কতিপয় লোকের কথা ভিন্ন। তারা নিজেদের কুকর্মের দ্বারা সৃষ্টিগত নূরকে ধ্বংস করে দিয়েছে। সম্ভবতঃ এ কারণেই আয়াতের শুরুতে নূর দান করার কথাটি ব্যাপকাকারে বর্ণনা করা হয়েছে, যাতে ভূমণ্ডল ও ভূমণ্ডলের অধিবাসীরা সবাই শামিল। এতে মুমিন ও কাফেরেরও প্রভেদ করা হয়নি। কিন্তু আয়াতের শেষে বলা হয়েছে
يَهْدِى اللهُ لِنُوْرِهٖ مَنْ يَّشَآءُ
অর্থাৎ “আল্লাহ্ তা‘আলা যাকে ইচ্ছা তাঁর নূরের দিকে পথ প্রদর্শন করেন”। এখানে আল্লাহ্র ইচ্ছার শর্তটি সেই সৃষ্টিগত নূরের সাথে সম্পৃক্ত নয়, যা প্রত্যেক মানুষের মধ্যে রাখা হয়; বরং এর সম্পর্ক কুরআনের নূরের সাথে, যা প্রত্যেকের অর্জিত হয় না। যারা আল্লাহ্র পক্ষ থেকে তাওফীক পায়, তারাই এই নূর লাভ করে। নতুবা আল্লাহ্র তৌফিক ছাড়া মানুষের চেষ্টাও অনর্থক; বরং মাঝে মাঝে ক্ষতিকরও হয়।
(তিন) এখানে نور দ্বারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অন্তরের নূরকে বুঝানো হয়েছে। ইমাম বাগভী বর্ণনা করেন যে, একবার ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু কা‘ব আহবারকে জিজ্ঞেস করলেনঃ এই আয়াতের তাফসীরে আপনি কি বলেন? ক‘ব আহবার তাওরাত ও ইঞ্জিলের সুপণ্ডিত মুসলিম ছিলেন। তিনি বললেনঃ এটা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের পবিত্র অন্তরের দৃষ্টান্ত। মিশকাত তথা তাক মানে তার বক্ষদেশ, زُخَاجَةٍ তথা কাঁচপাত্র মানে তার পবিত্র অন্তর এবং مِصْبَاحٌ তথা প্ৰদীপ মানে নবুয়ত। এই নবুয়তরূপী নূরের বৈশিষ্ট্য এই যে, প্রকাশিত ও ঘোষিত হওয়ার পূর্বেই এতে মানবমণ্ডলীর জন্য আলো ও ঔজ্জ্বল্য ছিল। এরপর ওহী ও ঘোষণা এর সাথে সংযুক্ত হলে এটা এমন নূরে পর্যবসিত হয়, যা সমগ্র বিশ্বকে আলোকোজ্জ্বল করে দেয়। [দেখুন-ইবন কাসীর, কুরতুবী, বাগভী]
[৩] এতে প্রমাণিত হয় যে, যয়তূন ও যয়তূন বৃক্ষ কল্যাণময় ও উপকারী। আলেমগণ বলেনঃ আল্লাহ্ তা‘আলা এতে অগণিত উপকারিতা নিহিত রেখেছেন। একে প্রদীপে ব্যবহার করা হয়। এর আলো অন্যান্য তৈলের আলোর চাইতে অধিক স্বচ্ছ হয়। একে রুটির সাথে ব্যবহার করা হয়। এর ফলও ভক্ষিত হয়। এর তৈল সংগ্ৰহ করার জন্য কোন যন্ত্র অথবা মাড়াইকল ইত্যাদির প্রয়োজন হয় না- আপনাআপনিই ফল থেকে তৈল বের হয়ে আসে। [বাগভী] রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ “যয়তুন তৈল খাও এবং শরীরে মালিশও কর। কেননা, এটা কল্যাণময় বৃক্ষ।” [তিরমিযীঃ ১৮৫১, ১৮৫২, ইবনে মাজহঃ ৩৩১৯]
____________________
[১] পূর্ববর্তী আয়াতে আল্লাহ্ তা‘আলা মানুষের অন্তরে নিজের হেদায়াতের আলো রাখার একটি বিশেষ দৃষ্টান্ত বর্ণনা করেছেন এবং শেষে বলেছেনঃ এই নূর দ্বারা সে-ই উপকার লাভ করে, যাকে আল্লাহ্ চান ও তাওফীক দেন। [ইবন কাসীর] আলোচ্য আয়াতে এমন মুমিনদের আবাসস্থল ও স্থান বর্ণনা করা হয়েছে যে, এরূপ মুমিনদের আসল আবাসস্থল, যেখানে তারা প্রায়ই বিশেষতঃ পাঁচ ওয়াক্ত সালাতের সময় দৃষ্টিগোচর হয়- সেসব গৃহ, যেগুলোকে উচ্চ রাখার জন্য এবং যেগুলোতে আল্লাহ্র নাম উচ্চারণ করার জন্য আল্লাহ্ তা‘আলা আদেশ করেছেন। এসব গৃহে সকাল-সন্ধ্যায় অর্থাৎ সর্বদা এমন লোকেরা আল্লাহ্ তা‘আলার পবিত্ৰতা বর্ণনা করে, যাদের বিশেষ গুণাবলী পরবর্তী আয়াতে বর্ণিত হচ্ছে। অধিকাংশ তাফসীরবিদের মতে এসব গৃহ হচ্ছে মসজিদ। অধিকাংশ মুফাসসিরগণ এ তাফসীরকেই অগ্ৰাধিকার দিয়েছেন। [দেখুন-কুরতুবী, বাগভী]
[২] কোন কোন মুফাসসির এর অর্থ নিয়েছেন মু‘মিনদের ঘর এবং সেগুলোকে উন্নত করার অর্থ সেগুলোকে নৈতিক দিক দিয়ে উন্নত করা, নৈতিক মান রক্ষার জন্য তাতে মসজিদের ব্যবস্থা করা। এ অর্থের সমর্থনে আমরা আয়েশা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা থেকে একটি হাদীস পাই যাতে তিনি বলেছেনঃ রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদেরকে বাসগৃহের মধ্যেও মসজিদ অর্থাৎ সালাত আদায় করার বিশেষ জায়গা তৈরী করার এবং তাকে পবিত্র রাখার জন্য আদেশ করেছেন। [ইবনে মাজহঃ ৭৫৮, ৭৫৯]
তবে অধিকাংশ মুফাসসির এ “ঘরগুলো”কে মসজিদ অর্থে গ্রহণ করেছেন এবং এগুলোকে উন্নত করার অর্থ নিয়েছেন এগুলো নির্মাণ ও এগুলোকে মর্যাদা প্ৰদান করা। “সেগুলোর মধ্যে নিজের নাম স্মরণ করতে আল্লাহ্ নির্দেশ দিয়েছেন।” এ শব্দগুলো বাহ্যত মসজিদ সংক্রান্ত ব্যাখ্যার বেশী সমর্থক দেখা যায়। তখন আয়াতের অর্থ হবে, আল্লাহ্ তা‘আলা মসজিদসমূহকে সমুন্নত করার অনুমতি দিয়েছেন। অনুমতি দেয়ার মানে আদেশ করা এবং উচ্চ করা মানে সম্মান করা। উচ্চ করার দু’টি অর্থ করা হয়ে থাকে-
[১] ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা বলেনঃ উচ্চ করার অর্থ আল্লাহ্ তা‘আলা মসজিদসমূহে অনৰ্থক কাজ ও কথাবার্তা বলতে নিষেধ করেছেন।
হাসান বসরী রাহিমাহুল্লাহ বলেনঃ رِفْعُ مَسَا جِدَ বলে মসজিদসমূহের সম্মান, ইযযত ও সেগুলোকে নাপাকী ও নোংরা বস্তু থেকে পবিত্র রাখা বুঝানো হয়েছে। আনাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেনঃ আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি, “মসজিদে থুথু ফেলা গোনাহ আর তার কাফফারা হলো তা দাফন করা, মিটিয়ে দেয়া”। [বুখারীঃ ৪১৫, মুসলিমঃ ৫৫২]
[২] ইকরিমা ও মুজাহিদ বলেনঃ رفع বলে মসজিদ নির্মাণ বুঝানো হয়েছে; যেমন কা‘বা নির্মাণ সম্পর্কে কুরআনে বলা হয়েছেঃ
وَ اِذْ يَرْ فَعُ اِبْرٰحٖمُ الْقًو اعِدَمِنَ الْبَيْتِ
এখানে رفع قو اعد বলে ভিত্তি নির্মাণ বুঝানো হয়েছে। উসমান রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেনঃ আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি, “যে আল্লাহ্র জন্য মসজিদ বানায়, আল্লাহ্ তার জন্য জান্নাতে একটি ঘর বানাবেন”। [বুখারীঃ ৪৫০, মুসলিমঃ ৫৩৩]
প্রকৃত কথা এই যে, تُرْفَعَ শব্দের অর্থ মসজিদ নির্মাণ করা, পাক-পবিত্র রাখা এবং মসজিদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা ইত্যাদি সবই অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। [দেখুন-তাবারী, ইবন কাসীর, কুরতুবী] এ কারণেই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম রসুন ও পেঁয়াজ খেয়ে মুখ না ধুয়ে মসজিদে গমন করতে নিষেধ করেছেন। উমার রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেনঃ “আমি দেখেছি, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে ব্যাক্তির মুখে রসুন বা পেঁয়াজের দুৰ্গন্ধ অনুভব করতেন, তাকে মসজিদ থেকে বের করে ‘বাকী’ নামক স্থানে পাঠিয়ে দিতেন এবং বলতেনঃ যে ব্যাক্তি রসুন-পেঁয়াজ খেতে চায়, সে যেন উত্তম রূপে পাকিয়ে খায় যাতে দুৰ্গন্ধ নষ্ট হয়ে যায়।” [মুসলিমঃ ৫৬৭]
[৩] আবু উমামাহ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বৰ্ণিত হাদীসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ “যে ব্যাক্তি গৃহে অযু করে ফরয সালাত আদায়ের জন্য মসজিদের দিকে যায়, তার সওয়াব সেই ব্যক্তির সমান, যে ইহরাম বেঁধে গৃহ থেকে হজ্জের জন্য যায়। যে ব্যাক্তি এশরাকের সালাত আদায়ের জন্য গৃহ থেকে অযু করে মসজিদের দিকে যায়, তার সওয়াব উমরাকারীর অনুরূপ। এক সালাতের পর অন্য সালাত ইল্লিয়্যীনে লিখিত হয় যদি উভয়ের মাঝখানে কোন অপ্রয়োজনীয় কাজ না করে।” [আবু দাউদঃ ৫৫৮] রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরো বলেনঃ “যারা অন্ধকারে মসজিদে গমন করে, তাদেরকে কেয়ামতের দিন পরিপূর্ণ নূরের সুসংবাদ শুনিয়ে দাও।” [আবু দাউদঃ ৫৬১, তিরমিযীঃ ২২৩]
[৪] আল্লাহ্র নাম স্মরণ করা দ্বারা এখানে তাসবীহ (পবিত্রতা বর্ণনা), তাহমীদ (প্ৰশংসা বর্ণনা), নফল সালাত, কুরআন তিলাওয়াত, ওয়াজ-নসীহত, দ্বীনী শিক্ষা ইত্যাদি সর্বপ্রকার যিকর বুঝানো হয়েছে। [তাবারী, সা‘দী, মুয়াসসার]
____________________
[১] এখানে رجال শব্দের মধ্যে ইঙ্গিত আছে যে, মসজিদে উপস্থিত হওয়ার বিধান আসলে পুরুষদের জন্য, নারীদের জন্য গৃহে সালাত আদায় করা উত্তম। [বাগভী, কুরতুবী] মুসনাদে আহমাদে উম্মে সালমা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা বর্ণিত হাদীসে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ “নারীদের উত্তম মসজিদ তাদের গৃহের সংকীর্ণ ও অন্ধকার প্রকোষ্ঠ”। [মুসনাদে আহমাদঃ ৬/২৯৭]
____________________
[১] আল্লাহ্ তা‘আলা তাদেরকে তাদের কর্মের উৎকৃষ্টতম প্রতিদান দেবেন। অর্থাৎ শুধু কর্মের প্রতিদানই শেষ নয়; বরং আল্লাহ্ নিজ কৃপায় তাদেরকে বাড়তি নেয়ামতও দান করবেন। [মুয়াসসার]
____________________
[১] অর্থাৎ আল্লাহ্র পক্ষ থেকে তাঁর নবীগণ এবং সে সময় আল্লাহ্র নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যে সত্যের শিক্ষা দিচ্ছিলেন সরল মনে তা মেনে নিতে অস্বীকার করে। [দেখুন-মুয়াসসার]
[২] কোন কোন মুফাসসির বলেন, এ আয়াতে ‘সেখানে’ বলে দুনিয়াই উদ্দেশ্য নেয়া হয়েছে। কারণ, আল্লাহ্র পক্ষ থেকে কাফেরদের কর্মকাণ্ডের যাবতীয় প্রতিফল দুনিয়াতেই দিয়ে দেয়া হবে। যেমনিভাবে অন্য আয়াতে বলা হয়েছে, “যে কেউ পার্থিব জীবন ও তার শোভা কামনা করে, দুনিয়াতে আমি ওদের কাজের পূর্ণ ফল দান করি এবং সেখানে তাদেরকে কম দেয়া হবে না। ওদের জন্য আখিরাতে আগুন ছাড়া অন্য কিছুই নেই এবং ওরা যা করে আখিরাতে তা নিষ্ফল হবে এবং ওরা যা করে থাকে তা নিরর্থক।” [সূরা হুদঃ ১৫-১৬] অন্যত্র এসেছে, “যে কেউ আখিরাতের ফসল কামনা করে তার জন্য আমি তার ফসল বাড়িয়ে দেই এবং যে কেউ দুনিয়ার ফসল কামনা করে আমি তাকে তা থেকে কিছু দেই, আখিরাতে তার জন্য কিছুই থাকবে না।” [সূরা আশ-শূরাঃ ২০] তবে অধিকাংশ আলেমদের নিকট এ আয়াতে ‘সেখানে’ বলে আখেরাতে মহান আল্লাহ্র দরবারে উপস্থিতির কথা বুঝানো হয়েছে। সেখানে তারা দুনিয়াতে যা করেছে সেটার প্রতিফল যদি প্রাপ্য হতো তবে তা দেয়া হতো। কিন্তু যেহেতু তাদের কৃত যাবতীয় কর্ম বিনষ্ট হয়েছে সেহেতু তারা সেখানে কিছুই পাবে না। যেমন, অন্য আয়াতে বলা হয়েছেঃ “আর আমরা তাদের কৃতকর্মের প্রতি লক্ষ্য করব, তারপর সেগুলোকে বিক্ষিপ্ত ধূলিকণায় পরিণত করব।” [সূরা আল-ফুরকানঃ ২৩]
____________________
[১] আয়াতের শুরুতে বলা হয়েছে যে, নভোমণ্ডল, ভূমণ্ডল ও এতদুভয়ের অন্তর্বর্তী প্রত্যেক সৃষ্টবস্তু আল্লাহ্ তা‘আলার পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণায় মশগুল। এই পবিত্রতা ঘোষণার অর্থ কোন কোন মুফাসসিরের মতে এই যে, আল্লাহ্ তা‘আলা পৃথিবীর প্রত্যেক বস্তু আসমান, যমীন, চন্দ্ৰ-সূৰ্য, গ্রহ, উপগ্রহ, নক্ষত্র, উপাদান চতুষ্টয় অগ্নি, পানি, মাটি, বাতাস সবাইকে বিশেষ বিশেষ কাজের জন্য সৃষ্টি করেছেন এবং যাকে যে কাজের জন্য সৃষ্টি করেছেন, সে সর্বক্ষণ সে কাজে ব্যাপৃত আছে এর চুল পরিমাণও বিরোধিতা করে না। এই আনুগত্যকেই তাদের পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা বলা হয়েছে।
কোন কোন তাফসীরবিদ বলেনঃ এটা অবান্তর নয় যে, আল্লাহ্ তা‘আলা প্রত্যেক বস্তুর মধ্যে এতটুকু বোধশক্তি ও চেতনা নিহিত রেখেছেন, যদ্বারা সে তার স্রষ্টা ও প্রভুর পরিচয় জানতে পারে এবং এটাও অবাস্তব নয় যে, তাদেরকে বিশেষ প্রকার বাকশক্তি দান করা হয়েছে ও বিশেষ প্রকার তাসবীহ এবং ইবাদাত শেখানো হয়েছে; যাতে তারা মশগুল থাকে। كُلٌّ قَدْ عَلِمَ صَلَاتَهٗ এই শেষ বাক্যে এ বিষয়বস্তুর প্রতি ইঙ্গিত পাওয়া যায় যে, আল্লাহ্ তা‘আলার তাসবীহ ও সালাতে সমগ্র সৃষ্টজগতই ব্যাপৃত আছে, কিন্তু প্রত্যেকের সালাত ও তাসবীহর পদ্ধতি ও আকার বিভিন্নরূপ। ফিরিশতাদের পদ্ধতি ভিন্ন, মানুষের পদ্ধতি ভিন্ন এবং উদ্ভিদরা অন্য পদ্ধতিতে সালাত ও তাসবীহ আদায় করে। জড় পদার্থের পদ্ধতিও ভিন্নরূপ। [দেখুন-তাবারী, কুরতুবী, সা‘দী, ফাতহুল কাদীর]
____________________
[১] সবকিছুই তাঁর মালিকানাভুক্ত। তারা ইচ্ছায়-অনিচ্ছায় তাঁর কাছেই ফিরে যাবে। তাদের মধ্যে যারা সেথায় তাসবীহ পাঠ করেছে তারা হবে পুরস্কৃত। আর যারা করেনি তারা হবে তিরস্কৃত। [দেখুন-তাবারী, মুয়াসসার]
____________________
[১] অর্থাৎ যিনি এ মেঘমালা সৃষ্টি করেছেন এবং এটাকে তিনি তার মুখাপেক্ষী বান্দাদের জন্য হাঁকিয়ে নিয়ে গেছেন, আর এমনভাবে সেটাকে নাযিল করেছেন যে এর দ্বারা উপকার অর্জিত হয়েছে, ক্ষতি থেকে বাঁচা সম্ভব হয়েছে, তিনি কি পূর্ণ শক্তিমান, ইচ্ছা বাস্তবায়নকারী, প্রশস্ত রহমতের অধিকারী নন? [সা‘দী]
____________________
[১] অর্থাৎ তিনি ঠাণ্ডা থেকে গরম, আবার গরম থেকে ঠাণ্ডা, দিন থেকে রাত আবার রাত থেকে দিন তিনিই পরিবর্তন করেন। অনুরূপভাবে তিনিই বান্দাদের মধ্যে দিনগুলো ঘুরিয়ে আনেন। [সা‘দী]
[২] যারা সত্যিকার বান্দা, বুদ্ধি ও বিবেকবান, তারা এগুলোর প্রতি দৃষ্টি দিয়ে এগুলো কেন সৃষ্টি করা হয়েছে সেটা সহজেই বুঝতে পারে। কিন্তু তারা ব্যতিক্রম, যারা পশুদের মত এগুলোর দিকে তাকায়। [সা‘দী]
____________________
[১] সুতরাং যেগুলো জন্তু সেগুলো বীর্য থেকে সৃষ্টি হয়। যা পুরুষ জন্তু মাদী জন্তুর উপর ফেলে। আর যেগুলো যমীনে তৈরী হয়, সেগুলোও আদ্র যমীন ছাড়া তৈরী হয় না। যেমন, কীট-পতঙ্গ। সুতরাং কোন কিছুই পানি ব্যতীত সৃষ্টি হয় না। [সা‘দী]
____________________
[১] এই আয়াতে চারটি বিষয় বর্ণনা করার পর বলা হয়েছে, যে ব্যাক্তি এই চারটি বিষয় যথাযথ পালন করে, সে-ই দুনিয়া ও আখেরাতে সফলকাম। [দেখুন-তাবারী, ইবন কাসীর, ফাতহুল কাদীর] কোন কোন তাফসীর গ্রন্থে এ প্রসঙ্গে উমার রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুর একটি ঘটনা বর্ণনা করা হয়েছে। এতে এই চারটি বিষয়ের ব্যাখ্যা ও পারস্পরিক পার্থক্য ফুটে উঠে। ফারূকে আযম একদিন মসজিদুন নববীতে দণ্ডায়মান ছিলেন। হঠাৎ, জনৈক রূমী গ্রাম্য ব্যাক্তি তার কাছে এসে বলতে লাগলোঃ
أَشْهَدُأن لَّاإِلٰهَ إِلَّا اللّٰهُ وَ أَشْهَدُ أَنَّ مُحَمَّدًا رَسُولُ اللّٰهِ
উমার রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু জিজ্ঞেস করলেনঃ ব্যাপার কি? সে বললোঃ আমি আল্লাহ্র ওয়াস্তে মুসলিম হয়ে গেছি। উমার রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু জিজ্ঞেস করলেনঃ এর কোন কারণ আছে কি? সে বললোঃ হ্যাঁ, আমি তাওরাত, ইঞ্জিল, যবূর ও পূর্ববর্তী নবীগণের অনেক গ্রন্থ পাঠ করেছি। কিন্তু সম্প্রতি জনৈক মুসলিম কয়েদীর মুখে একটি আয়াত শুনে জানতে পারলাম যে, এই ছোট্ট আয়াতটির মধ্যে সমস্ত প্রাচীন গ্রন্থের বিষয়বস্তু সন্নিবেশিত রয়েছে। এতে আমার মনের দৃঢ় বিশ্বাস জন্মেছে যে, এটা আল্লাহ্র পক্ষ থেকেই আগত। উমার রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু জিজ্ঞেস করলেনঃ আয়াতটি কি? রূমী ব্যাক্তি উল্লেখিত আয়াতটিই তিলাওয়াত করলো এবং সাথে সাথে তার অভিনব তাফসীরও বর্ণনা করলো যে, وَمَنْ يُّطِعِ اللهَ আল্লাহ্র ফরয কার্যাদির সাথে, وَرَسُوْلَهٗ রাসূলের সুন্নাতের সাথে, وَخَيْشَ اللهَ অতীত জীবনের সাথে এবং وَيَتَّقْهِ ভবিষ্যত জীবনের সাথে সম্পর্ক রাখে। মানুষ যখন এই চারটি বিষয় পালন করবে, তখন তাকে
فَاوُلَيِٓكَ هُمُ الْفَآىِٕزُوْنَ
এর সুসংবাদ দেয়া হবে। فاىٔز তথা সফলকাম সে ব্যাক্তি, যে জাহান্নাম থেকে মুক্তি ও জান্নাতে স্থান পায়। উমার রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু একথা শুনে বললেনঃ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের কথায় এর সমর্থন পাওয়া যায়। তিনি বলেছেনঃ “আল্লাহ্ তা‘আলা আমাকে সুদূরপ্রসারী স্বল্পবাক্যসম্পন্ন অথচ ব্যাপক অৰ্থবোধক বাক্যাবলী দান করেছেন।” [বুখারীঃ ২৮১৫, মুসলিমঃ ৫২৩]
____________________
[১] উবাই ইবনে কা‘ব রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেনঃ “রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং তার সাথীরা যখন মদীনায় তাশরীফ আনলেন এবং আনসারগণ তাদেরকে আশ্রয় দিলেন, তখন সমস্ত আরব এক বাক্যে তাদের শক্রতে পরিণত হলো। সাহাবাগণ তখন রাতদিন অস্ত্ৰ নিয়ে থাকতেন। তখন তারা বললোঃ আমরা কি কখনো এমনভাবে বাঁচতে পারবো যে, আল্লাহ্ ছাড়া আর কাউকে ভয় না করে সন্তুষ্ট চিত্তে ঘুমাতে পারবো? তখন এ আয়াত নাযিল হয়।” [ত্বাবারানী, মুজামুল আওসাত্বঃ ৭/১১৯, হাদীসঃ ৭০২৯, হাকীম- মুস্তাদরাকঃ ২/৪০১, দ্বিয়া আল-মাকদেসীঃ মুখতারাহঃ ১১৪৫]
এ আয়াতে আল্লাহ্ তা‘আলা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামকে তিনটি বিষয়ের ওয়াদা দিয়েছেন। [১] আপনার উম্মাতকে যমীনের বুকে খলীফা ও শাসনকর্তা করা হবে, [২] আল্লাহ্র মনোনীত দ্বীন ইসলামকে প্রবল করা হবে এবং [৩] মুসলিমদেরকে এমন শক্তি ও শৌর্যবীর্য দান করা হবে যে, তাদের অন্তরে শক্রর কোন ভয়ভীতি থাকবে না। আল্লাহ্ তা‘আলা তাঁর এই ওয়াদা পূর্ণ করেছেন। স্বয়ং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের পূণ্যময় আমলে মক্কা, খাইবার, বাহরাইন, সমগ্র আরব উপদ্বীপ ও সমগ্ৰ ইয়ামান তারই হাতে বিজিত হয় এবং তিনি হিজরের অগ্নিপূজারী ও শাম দেশের কতিপয় অঞ্চল থেকে জিযিয়া কর আদায় করেন। রোম সম্রাট হিরাক্লিয়াস মিসর ও আলেকজান্দ্ৰিয়ার সম্রাট মুকাউকিস, আম্মান ও আবিসিনিয়ার সম্রাট নাজ্জাসী প্রমুখ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে উপঢৌকন প্রেরণ করেন ও তার প্রতি সম্মান প্রদর্শন করেন। তার ওফাতের পর আবু বকর সিদ্দীক রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু খলীফা হন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওফাতের পর যে দ্বন্দ্ব-সংঘাত মাথাচাড়া দিয়ে উঠে, তিনি তা খতম করেন এবং পারস্য, সিরিয়া ও মিসর অভিমুখে সৈন্যাভিযান প্রেরণ করেন। বসরা ও দামেস্ক তারই আমলে বিজিত হয় এবং অন্যান্য দেশেরও কতক অংশ করতলগত হয়। আবু বকর সিদ্দীকের ওফাতের সময় নিকটবর্তী হলে আল্লাহ্ তা‘আলা তার অন্তরে উমর ইবনুল খাত্তাবকে পরবর্তী খলীফা নিযুক্ত করার ইলহাম করেন। উমার ইবনুল খাত্তাব খলীফা নিযুক্ত হয়ে শাসনব্যবস্থা এমনভাবে সুবিন্যস্ত করলেন যে, নবীগণের পর পৃথিবী এমন সুন্দর ও সুশৃংখল শাসন ব্যবস্থা আর প্রত্যক্ষ করেনি। তার আমলে সিরিয়া পুরোপুরি বিজিত হয়। এমনিভাবে মিসর ও পারস্যের অধিকাংশ এলাকা তার করতলগত হয়। তার হাতে কায়সার ও কিসরা সমূলে নিশ্চিহ্ন হয়। এরপর উসমান ইবন আফফান রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুর খেলাফতকালে ইসলামী বিজয়ের পরিধি পৃথিবীর পূর্ব ও পশ্চিম প্রান্ত পর্যন্ত বিস্তৃত হয়। পাশ্চাত্য দেশসমূহ, আন্দালুস ও সাইপ্রাস পর্যন্ত, দূরপ্রাচ্য চীন ভূখণ্ড পর্যন্ত এবং ইরাক, খোরাসান ও আহওয়ায ইত্যাদি সব তার আমলেই মুসলিমদের অধিকারভুক্ত হয়। [দেখুন-কুরতুবী] সহীহ হাদীসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ “আমাকে সমগ্ৰ ভূখণ্ডের পূর্ব ও পশ্চিম প্রান্ত একত্রিত করে দেখানো হয়েছে।” [সহীহ মুসলিমঃ ২৮৮৯] আল্লাহ্ তা‘আলা এই প্রতিশ্রুতি উসমান ইবন আফফান রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুর আমলেই পূর্ণ করে দেন। অন্য এক হাদীসে বলা হয়েছেঃ “খেলাফত আমার পরে ত্রিশ বছর থাকবে।” [আবু দাউদঃ ৪৬৪৬, তিরমিযীঃ ২২২৬, আহমাদঃ ৫/২২১]
____________________
[১] এর অর্থ হচ্ছে, তারা আমার কাছ থেকে হারিয়ে যাবে। বা তারা আমার পাকড়াও থেকে বেঁচে যাবে। [ফাতহুল কাদীর]
____________________
[১] এ আয়াতে বিশেষ তিনটি সময়ে অনুমতি চাওয়ার বিধান বর্ণনা করা হয়েছে। এই তিনটি সময় হচ্ছে ফযরের সালাতের পূর্বে, দুপুরের বিশ্রাম গ্রহণের সময় এবং এশার সালাতের পরবর্তী সময়। এই তিন সময়ে মাহরাম, আত্মীয়স্বজন এমনকি বুদ্ধিসম্পন্ন অপ্ৰাপ্তবয়স্ক বালক-বালিকা এবং দাসদাসীদেরকেও আদেশ করা হয়েছে, তারা যেন কারো নির্জন কক্ষে অনুমতি ব্যতীত প্রবেশ না করে। কেননা, এসব সময়ে মানুষ স্বাধীন ও খোলাখুলি থাকতে চায়, অতিরিক্ত বস্ত্রও খুলে ফেলে এবং মাঝে মাঝে স্ত্রীর সাথে খোলাখুলি মেলামেশায় মশগুল থাকে। এসব সময় কোন বুদ্ধিমান বালক অথবা গৃহের কোন নারী অথবা নিজ সন্তানদের মধ্য থেকে কেউ অনুমতি ব্যতীত প্রবেশ করলে প্রায়ই লজ্জার সম্মুখীন হতে হয় ও অত্যন্ত কষ্ট বোধ হয়, কমপক্ষে সংশ্লিষ্ট ব্যাক্তির খোলাখুলিভাবে থাকা ও বিশ্রামে বিঘ্ন সৃষ্টি হওয়া তো বলাই বাহুল্য। তাই আলোচ্য আয়াতসমূহে তাদের জন্য বিশেষ অনুমতি চাওয়ার বিধানাবলী বৰ্ণিত হয়েছে। এসব বিধানের পর একথাও বলা হয়েছে যে,
لَيْسَ عَلَيْهِمْ جُنَاحٌ مبَعْدَهُنَّ
অর্থাৎ এসব সময় ছাড়া একে অপরের কাছে অনুমতি ব্যতীত যাতায়াত করায় কোন দোষ নেই। [কুরতুবী]
____________________
[১] এখানে একটি নারীর ব্যাক্তিগত অবস্থার দিক দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি নীতি বর্ণনা করা হয়েছে। অর্থাৎ যে বৃদ্ধা নারীর প্রতি কেউ আকর্ষণ বোধ করে না এবং সে বিবাহেরও যোগ্য নয়, তার জন্য পর্দার বিধান শিথিল করা হয়েছে। অনাত্মীয় ব্যাক্তিও তার পক্ষে মাহরামের ন্যায় হয়ে যায়। মাহরামদের কাছে যেসব অঙ্গ আবৃত করা জরুরী নয়, এই বৃদ্ধা নারীর জন্য বেগানা পুরুষদের কাছেও সেগুলো আবৃত রাখা জরুরী নয়। এরূপ বৃদ্ধা নারীর জন্য বলা হয়েছে যেসব অঙ্গ মাহরামের সামনে খোলা যায়- যে মাহরাম নয় এরূপ ব্যাক্তির সামনেও সেগুলো খুলতে পারবে, কিন্তু শর্ত হচ্ছে যদি সাজসজ্জা না করে। পরিশেষে আরো বলা হয়েছে
وَاَنْ يَّسْتَعْفِفْنَ خَيْرٌلَّهُنَّ
অর্থাৎ সে যদি মাহরাম নয় এরূপ ব্যাক্তিদের সামনে আসতে পুরোপুরি বিরত থাকে, তবে তা তার জন্য উত্তম। কাজেই আয়াতের অর্থ হচ্ছে, চাদর নামিয়ে নেবার এ অনুমতি এমন সব বৃদ্ধাদেরকে দেয়া হচ্ছে যাদের সাজসজ্জা করার ইচ্ছা ও শখ খতম হয়ে গেছে এবং যাদের যৌন আবেগ শীতল হয়ে গেছে। কিন্তু যদি এ আগুনের মধ্যে এখনো একটি স্ফুলিংগ সজীব থেকে থাকে এবং তা সৌন্দর্যের প্রদর্শনীর রূপ অবলম্বন করতে থাকে তাহলে আর এ অনুমতি থেকে লাভবান হওয়া যেতে পারে না। [দেখুন- মুয়াসসার, সা‘দী]
____________________
[১] আয়াতের অর্থ নির্ধারনে বেশ কয়েকটি মত এসেছে,
(এক)
لَاتَجْعَلُوْادُعَآءَالرَّسُوْلِ بَيْنَكُمْ
এর অর্থ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের তরফ থেকে মুসলিমদেরকে ডাকা। (ব্যাকরণগত কায়দার দিক দিয়ে এটা إضافةإلى الفا عل) আয়াতের অর্থ এই যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন ডাকেন, তখন একে সাধারণ মানুষের ডাকার মত মনে করো না যে, সাড়া দেয়া না দেয়া ইচ্ছাধীন; বরং তখন সাড়া দেয়া ফরয হয়ে যায় এবং অনুমতি ছাড়া চলে যাওয়া হারাম হয়ে যায়। আয়াতের বর্ণনাধারার সাথে এই তাফসীর অধিক নিকটবর্তী ও মিলে যায়। (দুই) আয়াতের অপর একটি তাফসীর ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে ইবনে কাসীর, কুরতুবী প্রমুখ বৰ্ণনা করেছেন। তা এই যে, دُعَآءَالرَّسُوْلِ এর অর্থ মানুষের তরফ থেকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামকে কোন কাজের জন্য ডাকা। (ব্যাকরণগত কায়দার দিক দিয়ে এটা إضافةإلى المفعول)। এই তাফসীরের ভিত্তিতে আয়াতের অর্থ এই যে, যখন তোমরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামকে কোন প্রয়োজনে আহ্বান কর অথবা সম্বোধন কর, তখন সাধারণ লোকের ন্যায় তার নাম নিয়ে ‘ইয়া মুহাম্মাদ’ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলবে না- এটা বেআদবী; বরং সম্মানসূচক উপাধি দ্বারা ‘ইয়া রাসূলাল্লাহ’ অথবা ‘ইয়া নবীআল্লাহ্’ বলবে। [বাগভী]
[২] অর্থাৎ যারা রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রদর্শিত পথের বিরোধিতা করে, তার প্রবর্তিত শরীয়ত ও আইন অনুসারে জীবন পরিচালনা করে না, তার সুন্নাতের বিরোধিতা করে, তারা যেন তাদের অন্তরে কুফরী, নিফাকী, বিদ‘আত ইত্যাদি লালন করে অথবা তারা তাতে নিপতিত হওয়ার আশংকা করে। আরো আশংকা করে যে, তাদের উপর কঠোর শাস্তি আসবে। হত্যা, দণ্ডবিধি, জেল ইত্যাদি দুনিয়াতে এবং আখেরাতেও তাদের জন্য রয়েছে কঠোর শাস্তি। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ “যে ব্যাক্তি এমন কোন কাজ করবে যা আমার প্রদর্শিত পথের উপর নয়, তা তার উপরই ফিরিয়ে দেয়া হবে, গ্ৰহণযোগ্য হবে না।” [বুখারীঃ ২৬৯৭, মুসলিমঃ ১৭১৮]
অন্য এক হাদীসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ “আমার এবং তোমাদের মাঝে উদাহরণ হলো এমন এক ব্যাক্তির, যে আগুন জ্বালালো, তারপর সে আলোয় যখন চতুর্দিক আলোকিত হলো, তখন দেখা গেল যে, পোকামাকড় এবং ঐসমস্ত প্ৰাণী যা আগুনে পড়ে, সেগুলো আগুনে পড়তে লাগলো। তখন সে ব্যাক্তি তাদেরকে আগুন থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে চাইলো। কিন্তু সেগুলো তাকে ছাড়িয়ে সে আগুনে ঝাঁপ দিতে থাকলো। তারপর রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ এটাই হলো আমার এবং তোমাদের উদাহরণ। আমি তোমাদের কোমরের কাপড়ের গিরা ধরে আগুন থেকে দূরে রাখছি এবং বলছিঃ আগুন থেকে দূরে থাক। কিন্তু তোমরা আমাকে ছাড়িয়ে ছুটে গিয়ে আগুনে ঝাঁপ দিচ্ছ।” [বুখারীঃ ৬৪৮৩, মুসিলিমঃ ২২৮৪]